সেন্সর বোর্ডে প্রায় আট বছর ধরে আটকে আছে চাকমা ভাষায় নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা মর থেংগারি। শনিবার বিকেল নিয়ে আলোচনার মধ্যে তরুণ নির্মাতা অং রাখাইনের মর থেংগারি সিনেমা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হয়েছেন অনেকে।
ফেসবুকে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, সিনেমাটি এত বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে কেন? সাধারণ দর্শকের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীসহ নানা পেশার মানুষ সিনেমাটি নিয়ে সরব। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে নির্মাতা অং রাখাইন প্রথম আলোকে জানান, ২০১৫ সালের মে মাসে সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছেন তিনি; মাঝে প্রায় আট বছর পেরোলেও সেন্সর ছাড়পত্র মেলেনি।
অং রাখাইন জানান, সিনেমাটি জমা দেওয়ার কয়েক মাস পর তাঁকে জানানো হয়, সেন্সর বোর্ডে সিনেমাটির প্রদর্শনী হবে। তবে পরে সেই প্রদর্শনী স্থগিত করা হয়। এরপর সেন্সর বোর্ডে কয়েক দফায় যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পাননি তিনি। কয়েক মাস পর সেন্সর বোর্ড থেকে তাঁকে জানানো হয়, সিনেমার একটি দৃশ্য কর্তন করলে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়া হবে। ছাড়পত্র পাওয়ার আশায় ২০ সেকেন্ডের দৃশ্যটি কর্তনও করেছিলেন তিনি।
আমার ছবিটা ৬৪ মিনিটের, সেখান থেকে ২৫ মিনিট কাটলে ছবিটাই তো আর থাকে না। সেই ছবির সেন্সর ছাড়পত্র নিয়ে আমি কী করব?’
অং রাখাইন বলছেন, সেই ২০ সেকেন্ডের দৃশ্য কর্তনের পর তাঁকে আরও প্রায় ২৫ মিনিটের দৃশ্য কর্তন করতে বলা হয়। ‘আমার ছবিটা ৬৪ মিনিটের, সেখান থেকে ২৫ মিনিট কাটলে ছবিটাই তো আর থাকে না। সেই ছবির সেন্সর ছাড়পত্র নিয়ে আমি কী করব?’ সেন্সর বোর্ডের পক্ষ থেকে নির্দেশিত দৃশ্যগুলো কী? এ প্রশ্নের জবাবে নির্মাতা বলেন, ‘কাপ্তাই লেকের দৃশ্য, এলাকার চাঁদাবাজি, ধর্মীয় আচারের দৃশ্য রয়েছে।’
২০১৬ সালে শেষবারের মতো সেন্সর বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন নির্মাতা অং রাখাইন। মাঝে সাত বছরের বেশি সময় কেটে গেছে, সেন্সর বোর্ডে একের পর এক চেয়ারম্যান এসেছেন, গেছেন। কিন্তু অং রাখাইনের স্বপ্নের সিনেমাটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মুহ. সাইফুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। নাম না প্রকাশের শর্তে সেন্সর বোর্ডের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিনেমাটি নিয়ে সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল, তা নির্মাতাকে জানানোও হয়েছিল। পরে তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।’ দৃশ্যগুলো কর্তনের বিষয়ে যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দিতে চাননি।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের দাপ্তরিক ভাষায় ‘পর্যবেক্ষণ’ মানে সিনেমায় কাঁচি চালাতে হবে। গত কয়েক বছরে সাহস, বর্ডারসহ বেশ কয়েকটি সিনেমায় কাঁচি চালিয়েছে সেন্সর বোর্ড। কোনো কোনো সিনেমার নামই বদলে ফেলা হয়েছে, তবে নির্মাতা–প্রযোজকেরা বলছেন, কোনো সিনেমা থেকে ২০ মিনিটের মতো দৃশ্য ফেলা হলে সেই সিনেমার আর উপযোগিতা থাকে না।
নির্মাতা মাতিয়া বানু শুকু মর থেংগারি সিনেমাটি দেখেছেন; বছরের পর বছর ধরে সেন্সর বোর্ডে সিনেমাটির আটকে থাকা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন তিনি। মাতিয়া বানু শুকু প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৫ মিনিট ফেলে দেওয়া মানে একটি সিনেমার অর্ধেকটাই ফেলে দিলাম। একটা মানুষের অর্ধেকটা কেটে দেওয়ার মতো। এমন পঙ্গু জিনিস দেখানোর তো কোনো মানেই হয় না।’
চাকমা ভাষায় থেংগারি শব্দের অর্থ বাইসাইকেল; সিনেমার ইংরেজি নাম মাই বাইসাইকেল। সিনেমার কাহিনি আবর্তিত হয়েছে পাহাড়ঘেড়া এক গ্রামের কমল নামের এক চাকমা যুবককে ঘিরে। শহরে জীবিকা অর্জনে বিফল হয়ে একটি বাইসাইকেল নিয়ে গ্রামে ফেরত আসেন তিনি। বাইসেকেলে মানুষ ও মালামাল পরিবহন করে জীবিকার সন্ধান করতে থাকেন তিনি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ১৩তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসবে এ সিনেমার প্রিমিয়ার হয়েছে। এরপর দেশ ও দেশের বাইরে কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছে। এতে চাকমা সম্প্রদায়ের সদস্যরাই অভিনয় করেছেন।
শুধু মর থেংগারি নয়, গত কয়েক দশকে হরিবোল, মেকআপসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা সেন্সর বোর্ডে বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা নিয়ে নির্মিত রানা প্লাজা সিনেমা নিষিদ্ধ করে সরকার। নবাব এলএলবি সিনেমায় পুলিশ নিয়ে ‘অশালীন সংলাপের’ অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনয়শিল্পী শাহীন মৃধাকে জেলে ভরা হয়েছিল। ১৫ দিন পর জামিনে মুক্ত হয়েছেন তাঁরা।
নবাব এলএলবি সিনেমায় পুলিশ নিয়ে ‘অশালীন সংলাপের’ অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনয়শিল্পী শাহীন মৃধাকে জেলে ভরা হয়েছিল। ১৫ দিন পর জামিনে মুক্ত হয়েছেন তাঁরা।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে গল্প বলার স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে বলে অভিযোগ করছেন নির্মাতারা, বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে ফিল্ম অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ (ফ্যাব) নামে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রযোজক, নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীরা আট দফা দাবি তুলেছেন। সেন্সর বোর্ডে বছরের পর বছর ধরে সিনেমা আটকে থাকাকে ‘অযৌক্তিক’ বলেছে ফ্যাব।
সিনেমা নির্মাণের আগেই আমাদের সেন্সর করতে হয়। মাথায় রাখতে হয়, এটা দেখানো যাবে না, ওটা দেখানো যাবে না। তারপর যেটুকু থাকে, সেখানেও কর্তন দেওয়া হয়। তাহলে আমরা দেখাব কী, আমাদের আগে জানিয়ে দিলেই হয়। আমরা কিছুই দেখাব না, শুধু ক্যামেরার সামনে রঙ্গ করব।
মাতিয়া বানু শুকু বলছেন, ‘সিনেমা নির্মাণের আগেই আমাদের সেন্সর করতে হয়। মাথায় রাখতে হয়, এটা দেখানো যাবে না, ওটা দেখানো যাবে না। তারপর যেটুকু থাকে, সেখানেও কর্তন দেওয়া হয়। তাহলে আমরা দেখাব কী, আমাদের আগে জানিয়ে দিলেই হয়। আমরা কিছুই দেখাব না, শুধু ক্যামেরার সামনে রঙ্গ করব।’
নিজের প্রথম সিনেমা আলোর মুখ না দেখলেও দমে যাননি অং রাখাইন; দ্বিতীয় সিনেমা ম্রো নির্মাণে হাত দিয়েছেন। ম্রো জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নির্মীয়মাণ সিনেমাটি ২০২৬ সাল নাগাদ মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।