আমি কখনো গান লিখতে চাইনি
‘আমার জীবনে একটাই অতৃপ্তি, কেন যে কণ্ঠে গান তুলে নিলাম না। তাহলে কবিতার হাত দিয়ে সুর ও বাণীসহযোগে শ্রোতাদের কিছু শ্রুতিমধুর গান দিতে পারতাম’—বলছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ৮০ বছর পূর্ণ হবে তাঁর ২৭ ডিসেম্বর। তাঁর লেখা অসংখ্য গান দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। সেই তালিকা থেকে কিছু গানের গল্প করেছেন কবির বকুলের সঙ্গে।
আমি কখনো গান লিখতে চাইনি। প্রথম গান লিখতে হয়েছিল প্রডাকশনের খরচ বাঁচাতে এবং সুরকার সত্য সাহাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সে গল্প আমি আগেও করেছি। সত্যিকার অর্থে একজন লিখছেন, একজন সুর করছেন। এটা আমার পছন্দ নয়। এতে সুর ও কথার বিচ্যুতি ঘটে। একজনই এই দুটো কাজ করলে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি হয় বলেই আমার বিশ্বাস। এ কারণে আমি গানটা লিখেছি বটে, কিন্তু মন কখনো সায় দেয়নি।
আমার লেখা প্রথম গান ছিল সুতরাং ছবির ‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে বলে শুধু মোরে’। এই ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং সবগুলো গান আমার লেখা। প্রথম গানটি লিখেছিলাম ফরাশগঞ্জে একটি বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ১৯৬১ সালে। সেখানে একটি মেসে থাকতেন সত্য সাহা। গানটি একসঙ্গে বসেই করা। আমি এক লাইন লিখেছি, আর সত্য সেটা সুর করেছেন। এভাবেই তৈরি হয় গানটি। শুনে পরিচালক সুভাষ দত্ত বললেন, ‘আঞ্জুমান আরা বেগম গানটি ভালো গাইবেন।’ গানটির রেকর্ড হয়েছিল এফডিসিতে। লিটল অর্কেস্ট্রা বাজিয়েছিল। তখন সরাসরি রেকর্ডিং হতো। যন্ত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী একসঙ্গে। একবার ভুল হলে আবার প্রথম থেকে শুরু। মনে আছে, রাত ১০টায় শুরু হলো, শেষ হলো রাত তিনটায়। এই গানটির শেষ মুখরাটুকু গেয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এই ছবিতেই ‘নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি, তাহার চেয়ে আরও বাঁকা তোমার ছলনা’—এই গানটিতে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমান দুই ভাই বোন একসঙ্গে প্রথম প্লেব্যাক করেন। এ ছাড়া আব্দুল আলীম আর কাজী আনোয়ার হোসেন গেয়েছিলেন ‘এই যে আকাশ, এই যে বাতাস, বউ কথা কও সুরে যেন ভেসে যায়, বেলা বয়ে যায়, মধুমতি গাঁয় ওরে মন ছুটে চল চেনা ঠিকানায়’। আরেকটি গান ‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না, বুবুমণির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা’। গেয়েছিল শিশুশিল্পী আলেয়া শরাফী। দিনের পর দিন ওই মেসে বসেই গানগুলো লেখা। ছবির সবগুলো গানই শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল।
সুভাষ দত্তের আরেকটি ছবি আয়না ও অবশিষ্ট। আমার লেখা এই ছবির ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, সে কি তুমি নও ওগো তুমি নও’—ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া এই গানটি ওই সময় ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। সুর করেছিলেন সত্য সাহা।
সত্য সাহার পর আমি হাতেগোনা কজন সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবদুল আহাদ, সমর দাস, আলম খান, বশীর আহমেদ। কাজী জহিরের ময়নামতি ছবিতে বশীর আহমেদের সুর ও কণ্ঠে আমার লেখা একটি গান বেশ আলোচিত হয়। গানটি ছিল ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়, মিছে তারে শিকল দিলাম রাঙা দুটি পায়’। মনে পড়ে, গানটি কাজী জহিরের গ্রিনরোডের বাসায় বসে লিখেছিলাম। তাঁর একটা কায়দা ছিল, সুরকারদের তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁর সামনে বসে সুর করতে হতো। সুর পছন্দ হলে তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়তেন। আর পছন্দ না হলে দাঁড়িয়ে যেতেন।
আমি আরেকটি ছবির সবগুলো গান লিখেছিলাম। ছবির নাম বড় ভালো লোক ছিল। এই ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপও আমার। আমি পীর বংশের ছেলে। ভেতরে একটা আধ্যাত্মিকতা কাজ করে। এ ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ লেখার সময় আমি অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোরের মধ্যেই ছবির গানগুলো লেখা। বিশেষ করে ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ গানটির কথা বলব। মনে আছে, এই ছবির গল্প নিয়ে মণিপুরি পাড়ায় আমার ভাড়াবাড়িতে যেদিন বসি, সেদিন আলম খানকে গানটির অস্থায়ীটুকু দিই। প্রায় তিন মাস পর এক সকালে বাসায় এসে অস্থায়ীর সুর শোনান আলম। প্রথম শুনেই ভালো লেগেছিল। ওই দিন তাঁকে আমি দুটো অন্তরা দিই। গানটি রেকর্ড হয়েছিল শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে। ছবির এই গানটিসহ আরও দুটো গান এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন। গান দুটো হলো ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাইয়া, রাস্তা দিয়া হাইটা চলে রাস্তা হারাইয়া’ এবং ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগৎ রঙ্গিলা’। ছবির আরও দুটো গান বেশ জনপ্রিয় হয়। দুটো গানই রুনা লায়লা গেয়েছিলেন। একটি অবশ্য দ্বৈত গান। রুনার সঙ্গে ছিলেন বিপুল ভট্টাচার্য। এই গানটি হলো ‘চাম্বেলিরও তেল দিয়া কেশ বান্ধিয়া’, অন্যটি ‘পাগল পাগল মানুষগুলো পাগল সারা দুনিয়া, কেহ পাগল রূপ দেখিয়া, কেহ পাগল শুনিয়া’।
আলমের সঙ্গে আমার আরও দুটো গান করা হয়েছিল। এই দুটো গানও ভীষণ জনপ্রিয় হয়। একটি মান সম্মান ছবির ‘কারে বলে ভালোবাসা কারে বলে প্রেম, মিলনে বিরহে আমি জানলেম’-এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া। অন্যটি আশীর্বাদ ছবির ‘চাঁদের সঙ্গে আমি দেব না তোমার তুলনা’। গেয়েছিলেন রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর। চলচ্চিত্রের জন্য এটাই ছিল আমার লেখা শেষ গান। এরপর আমি আর কোনো গান লিখিনি।