পুরোনো ছন্দেই ছন্দা
কখনোই শোবিজ থেকে বিদায় নেননি গোলাম ফরিদা ছন্দা। প্রায় ২০ বছর ধরে নিয়মিত পর্দায় অভিনয় করে চলেছেন। অথচ আজকাল দর্শকেরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাকে এত কম দেখি কেন?’ এমন জিজ্ঞাসার মুখে ছন্দা উত্তর দেন, ‘আপনারা টিভি কম দেখেন, তাই!’ জনপ্রিয় এই টিভি অভিনেত্রীর মতে, দেশে এখন অনেক চ্যানেল। প্রচারিত হয় অগণিত নাটক। দর্শকেরা ছুটে বেড়ান দেশি-বিদেশি চ্যানেলে চ্যানেলে। এ জন্যই ছন্দা নিয়মিত কাজ করার পরও তাঁকে অনেকে খুঁজে পান না! তিনি মনে করেন, আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছেন এখন।
শূন্য দশকের প্রথম দিকে ছন্দার ক্যারিয়ার ছিল পালতোলা নৌকার মতো। ভেসে গেছেন সাফল্যের স্রোতে। এর কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জিনাত হাকিমের রচনায় ‘কাজল কালো দিন’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন ছন্দা। তখন বিটিভির প্রতিষ্ঠিত প্রযোজকদের সঙ্গে কাজ করে দক্ষ হয়ে উঠছেন ছন্দা। একুশে টিভির যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। ছন্দা কাজ করেছেন একের পর এক দর্শকপ্রিয় নাটকে। তাঁর প্রিয় নাটকগুলোর সিংহভাগ সেই সময়ের। মুস্তাফা মনোয়ারের ‘স্ত্রীর পত্র’, সালাহউদ্দিন লাভলুর ‘একজন আয়নাল লস্কর’, সতীর্থ রহমান রুবেলের ‘মা’ ছন্দার একক নাটকগুলোর মধ্যে সেরা। ধারাবাহিকের মধ্যে ‘তিন দু গুণে সাত’, ‘সাকিন সারিসুরি’ ও ‘নীলকণ্ঠ পাখি’র প্রতি দুবলতা তাঁর।
২০০১ সালে নির্মাতা-অভিনেতা সতীর্থ রহমান রুবেলকে ভালোবেসে বিয়ে করেন ছন্দা। তখনো ছন্দপতন হয়নি তাঁর ক্যারিয়ারের। ২০০৫ সালে যমজ মেয়ে টাপুর ও টুপুরের জন্মের সময় ছন্দা কিছুটা ছন্দ হারিয়ে ফেলেন। আড়াই বছরের বিরতিতে যেতে হয় তাঁকে। এটাই ছন্দার ক্যারিয়ারের একমাত্র ছুটি। তিনি জানান, ফিরে আসার পর আগের চেয়েও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিরতির কোনো প্রভাব তাঁর ক্যারিয়ার পড়েনি। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, তত দিনে অনেক চ্যানেল সম্প্রচারে এসে গেছে। কাজের সংখ্যা বেড়ে যায় অভিনয়শিল্পীদের।
ছন্দা বলেন, ‘এমনও হয়েছে, ১২ চ্যানেলে একসঙ্গে ১২টা নাটক প্রচারিত হয়েছে আমার।’ তখন চুটিয়ে কাজ করেছেন। এখন কাজের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। দুই মেয়েকে পড়তে পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পংয়ে। ওখানকার একটা স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে টাপুর ও টুপুর। পাঁচ বছর ধরে ছন্দাকে তাই নাটকের কাজ করতে হয় মেয়েদের সঙ্গে ছুটিছাঁটা মিলিয়ে। কখনো কখনো মাস খানেকের জন্য চলে যেতে হয় ছন্দাকে। অবসরটাও পেয়ে যান। মেয়েদের দেখভালও করে আসেন। লকডাউনের আগে দুই মেয়ে ফিরে এসেছে মায়ের কাছে। ‘এখন সময় যে কীভাবে চলে যায়, তা বলতেই পারব না’, ছন্দার কণ্ঠ থেকে বুঝে নিতে হয়, মেয়েদের যত্ন নিয়ে কাটছে তাঁর সারা বেলা।
ছন্দার দুই মেয়ে শিশুকাল থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত। বাবা ও মা দুজনেই অভিনয়শিল্পী। শিল্পের ছায়া থেকে তাই তারা সরে যায়নি। এটুকু বয়সেই প্রচুর নাটকে অভিনয় করে ফেলেছে তারা। বড় মেয়ে টাপুর এক মিনিট বয়স থেকেই অভিনয় করছে! ছন্দা সেই মজার ঘটনার বর্ণনা দেন, ‘জন্মের পরপরই টাপুর অভিনয় করেছে। সুভাষ দত্ত আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁর ছবি ‘ও আমার ছেলে’তে এই ছেলেটাই টাপুর। এত অল্প বয়সের বাচ্চার তো ছেলেমেয়ের তফাত বোঝা যায় না। আর ছোট মেয়েটা প্রথম অভিনয় করেছে ওর বাবার নাটকে। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর নাটকে প্রথম কাজ করুক মেয়ে।’ টাপুর-টুপুর এখন ইউটিউবে নিজেদের কনটেন্ট নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বলে জানান গর্বিত মা।
করোনার দিনগুলো ছন্দা কাটিয়েছেন তাঁর উত্তরার বাসায় মেয়েদের সঙ্গে। অভিনয়ের বাইরে একটা লম্বা সময় তিনি দেন ভারতে মেয়েদের কাছে। ‘মেয়েরা কাছে থাকে না বলেই ওদের ছুটির সময় বেড়িয়ে আসি।’ বেড়ানোর বাইরে ছন্দা সময় কাটান ছাদে গাছগাছালির পরিচর্যায়। বই পড়েন, ছবি দেখেন। আর নিজেদের হাউস থেকে নাটক-টেলিফিল্ম নির্মাণ করেন। ওটা স্বামী সতীর্থই দেখেন। আগে সতীর্থ চুটিয়ে কাজ করলেও এখন করেন বেছে বেছে। উৎসব, পার্বণ ছাড়া কাজ করেন কম। ভারতে মেয়েদের ওখানে গেলে তিন–চারটা নাটকের শুটিং একসঙ্গে সেরে আসেন। সেগুলো ধীরে ধীরে প্রচারিত হয়। সতীর্থর কাজ কম করার পেছনেও অভিযোগের সুর পাওয়া যায় ছন্দার কণ্ঠে।
‘এখন যে পরিস্থিতি, নানা রকম প্রতিকূলতা, আমাদের অনেক গুণী নির্মাতা এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না। সতীর্থও তাঁদের মধ্যে একজন।’ গুণী নির্মাতাদের কথা বলতে গিয়ে ছন্দা কয়েকজন পরিচালকের নাম উচ্চারণ করেন, যাঁদের সঙ্গে করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন। তাঁর ক্যারিয়ারে ভূমিকা রেখেছেন এমন কয়েকজনের মধ্যে আছেন মুস্তাফা মনোয়ার, সালাহউদ্দিন লাভলু, মাহবুবুল আলম, কবির আনোয়ার, সাইদুল আনাম টুটুল, মোস্তাফিজুর রহমান, অরুণ চৌধুরী, মোহন খান, কায়সার আহমেদ প্রমুখ।
ছন্দা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলেন, ‘তখন যে ভালো লাগা নিয়ে কাজ করেছি, এখন যত কাজই করি, সেই ভালো লাগাটা আসলে তৈরি হয় না। একটা চরিত্রকে সময় দেওয়া, পড়াশোনা করে আদ্যোপান্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা—এসব এখন নেই। সেই মানের কাজের জন্য বাজেট নেই এখন। পুরোপুরি আপডেট হয়ে কাজ করতে চাইলেও বাজেটের জন্য করতে পারছি না। পরিচালক মনমতো শিল্পী নিতে পারছেন না। যাঁদের বাজারে কাটতি আছে, যাঁদের স্পনসর ভ্যালু আছে, অভিনয় পাকাপোক্ত না হোক, যতই ক্লিশে হোক, চ্যানেল থেকে হয়তো তাঁদের কথাই বলে দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে মিডিয়ায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পুরোনো সময়টা তাই আমার কাছে জ্বলজ্বলে হয়ে রয়ে গেছে।’
বাস্তবতা মেনে নিয়েও ছন্দা কাজ করছেন। তাঁর অভিনীত নাটক ও টেলিফিল্মের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছেন। সিনেমা করেছেন মাত্র একটি। অনেকের মতো করেছেন উপস্থাপনাও। শিগগিরই তাঁর ক্যারিয়ারে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। নাট্য পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছেন। শোক দিবসের জন্য নির্মিতব্য ‘জোছনা’ নাটকটি নির্দেশনা দেবেন ছন্দা। তিনি জানান, পরিচালনায় আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। হুট করেই নাম লেখাচ্ছেন। প্রযোজনা সংস্থা থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান। ‘জোছনা’র ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করবেন।