ওয়েব প্ল্যাটফর্ম ও ইউটিউবে প্রদর্শিত নাটক সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের অভিমত
ওয়েব প্ল্যাটফর্ম ও ইউটিউবের কনটেন্ট প্রদর্শনের বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তাফা মনোয়ার, ফেরদৌসী মজুমদার, মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, আবুল হায়াত, দিলারা জামান, আসাদুজ্জামান নূর, এ টি এম শামসুজ্জামান, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হারুন–অর–রশীদসহ দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। সেখানে তাঁরা মতামত দিয়েছেন, সম্প্রতি ওয়েবসাইট ও ইউটিউবে প্রদর্শিত কিছু নাটক বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে আঘাত হানতে শুরু করেছে। বিবৃতিতে তাঁরা জানিয়েছেন, প্রযুক্তির উত্তরোত্তর আধুনিকতার ফলে টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াই অন্যান্য মাধ্যমে, যেমন ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণ বা বর্জন করার পক্ষপাতি নন তাঁরা।
‘বিভিন্ন ওয়েব প্ল্যাটফর্ম ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রদর্শিত নাটক সম্পর্কে দেশের বিশিষ্টজনদের অভিমত’ শিরোনামের বিবৃতিটি হুবহু তুলে ধরার অনুরোধ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের অভিমত, এতে করে তাঁদের পুরো বক্তব্য স্পষ্ট হবে সবার কাছে। নিম্নে সেটি তুলে ধরা হলো:
অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, অনেক দিন ধরে কিছু ইউটিউব ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে অত্যন্ত দায়িত্বহীনতার সঙ্গে কিছু নির্মাতা, প্রযোজক, নাট্যকার ও অভিনয়শিল্পী কুরুচিপূর্ণ নাটক পরিবেশন করে আসছে। এই নাটকগুলোর মধ্যে কাহিনির প্রয়োজনে নয় একেবারেই বিকৃত রুচিসম্পন্ন নাটক নির্মাণ করে বিবেকবান ও সচেতন দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আমরা এহেন কাজকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করি, নিন্দা জানাই।
বাংলাদেশের টেলিভিশনের নাটক জন্মলগ্ন থেকেই পারিবারিক বিনোদনমাধ্যম হওয়ায় দর্শকের রুচি ও মূল্যবোধ নির্মাণে ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন আসার পর কিছু প্রতিভাবান নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা–অভিনেত্রী ও কলাকুশলী বাংলাদেশের এই মাধ্যমকে এক নতুন মহিমায় স্থাপন করেছিল। কিন্তু কিছু কিছু চ্যানেলে নাটকের মান এমনভাবে নেমে এসেছে যে বাংলাদেশের নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেক দর্শক।
এর মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রমী চ্যানেলে পরিচালকগণ কিছু ভালো কাজ করার তাগিদও অনুভব করেছে। যার প্রতিফলন আমরা প্রায়শই চ্যানেলগুলোতে দেখতে পাই। কিন্তু এর মধ্যে আবার অনলাইন প্রচারমাধ্যমগুলোতে অবাধ প্রচারের সুযোগে যৌনতা এবং ভায়োলেন্সকে উপজীব্য করে অশ্লীলতাকে আশ্রয় করেছে। সম্প্রতি সেই সব নাটক ওয়েবসাইট ও ইউটিউবে প্রদর্শিত হয়ে বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে আঘাত হানতে শুরু করেছে। এর আগে ভাষাকে বিকৃত করার মাধ্যমে কিছু পরিচালক নাটক নির্মাণ করায় জনরোষে পতিত হয় এবং মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনায় কিছুটা প্রশমিত হয়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি সম্প্রচার নীতিমালা প্রকাশ করে যেখানে বিষয়গুলো সম্পর্কে নির্দেশনা রয়েছে।
আশির দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার প্রবণতার ফলে দর্শক সিনেমা বর্জন করেছিল। একইভাবে দর্শক যদি আমাদের নাটক বর্জন করতে থাকে, তাহলে তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
প্রযুক্তির উত্তরোত্তর আধুনিকতার ফলে আমরা টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াই অন্যান্য মাধ্যমে সংযুক্ত হতে পারছি (যেমন ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম)। আমরা এসবকে নিয়ন্ত্রণ বা বর্জন করার পক্ষপাতী নই। আমরা শিল্পীর স্বাধীনতা ও ভিন্নমতে বিশ্বাসী। কাহিনির প্রয়োজনে কোনো শিল্পিত উপস্থাপনার খবরদারিতে আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু অপ্রয়োজনে শুধু দর্শক টানার মিথ্যা প্রলোভন আমাদের নাটক শুধুই বিনোদনের পণ্য হয়ে দাঁড়াক তা–ও চাই না।
এটিও উদ্বেগের বিষয় যে ওয়েব বা এই ধরনের প্ল্যাটফর্মে নাটক পাইরেসি হয়ে অন্যত্র চলে যায় এবং খণ্ডিতভাবে প্রকাশ হলে বিভ্রান্তি ছড়ায়, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। করোনা–পরবর্তী সময়ে শৈল্পিক উপস্থাপনায় নতুন অভিজ্ঞতায় উজ্জীবিত থেকে আমাদের শিল্প এক নতুন অভিধা সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্র, আইন, সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নয়, শিল্পীর নিজস্ব অভিব্যক্তি হবে প্রধান বিষয়। শিল্পী–কলাকুশলীদের পাশে দাঁড়াবার জন্য আমাদের সংগঠন। শিল্প এবং শিল্পীর ওপর যদি কোনো অন্যায় আঘাত আসে তার পাশে অবশ্যই দাঁড়াবে। এমতাবস্থায় নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কলাকুশলী—সবাইকে সুস্থ ও শৈল্পিক বিনোদনের প্রক্রিয়ায় আসার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
ধন্যবাদসহ—সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তাফা মনোয়ার, মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, আবুল হায়াত, দিলারা জামান, ফেরদৌসী মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, এ টি এম শাসমুজ্জামান, ড. ইনামুল হক, ম. হামিদ, কে এস ফিরোজ, জুয়েল আইচ, আফজাল হোসেন, আনিসুল হক (সাহিত্যিক ও সাংবাদিক), নওয়াজীশ আলী খান, আনোয়ার হোসেন বুলু, সানাউল আরেফিন, শর্মিলী আহমেদ, সারা যাকের, লাকী ইনাম, ফাল্গুনী হামিদ, গোলাম কুদ্দুছ (সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট), হাসান আরিফ (সাধারণ সম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট), ঝুনা চৌধুরী, কামাল বায়েজিদ (সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন), আহসান হাবিব (কার্টুনিস্ট), হারুন অর রশীদ (নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, ডিজি বিটিভি), তারিক আনাম খান, মান্নান হীরা, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ফেরদৌস হাসান, মোহন খান, মাসুম রেজা, সালাহউদ্দিন লাভলু, শহীদুজ্জামান সেলিম, অরুণ চৌধুরী, নাদের চৌধুরী, আজিজুল হাকিম, ফজলুর রহমান বাবু, তৌকির আহমেদ, জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, গাজী রাকায়েত, ইরেশ যাকের, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, তানিয়া আহমেদ, ত্রপা মজুমদার, শহীদুল আলম সাচ্চু, তুষার খান, মুশফিকুর রহিম গুলজার, খোরশেদ আলম খসরু, মাজহারুল ইসলাম (প্রযোজক ও প্রকাশক), শাকুর মজিদ, আহকাম উল্লাহ (সাধারণ সম্পাদক, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ), আহমেদ গিয়াস (সাধারণ সম্পাদক, পথনাটক পরিষদ), সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা(সিনিয়র সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন), মোহাম্মদ হোসেন জেমি, মনোয়ার পাঠান, আনজাম মাসুদ, ফারিয়া হোসেন, জিনাত হাকিম, চয়নিকা চৌধুরী, ইন্তেখাব দিনার, এজাজ মুন্না, শাহেদ শরীফ খান, দীপা খন্দকার, বৃন্দাবন দাস, পান্থ শাহরিয়ার, বিজরী বরকতউল্লাহ, তারিন জাহান, তানভীন সুইটি, রিচি সোলায়মান, চঞ্চল চৌধুরী, মীর সাব্বির, এস এ হক অলিক, আহসান হাবিব নাসিম ও সাজু মুনতাসির।