করোনাকালের কৃষ্ণ কবচ
হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে ঘুম ভেঙে গেল, চোখ চলে গেল সিলিংয়ে—দেখি, সুশান্ত রাজপুতের পা দুটো ঝুলছে। মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখি রাত তিনটা, চন্দ্রাহতের মতো পড়ে থাকি কিছুক্ষণ।
তারপর মোবাইল হাতড়ে চলে যাই খবরে... স্ক্রিনে ভেসে ওঠে লাল আগুনের ছবি, আরেক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদে জ্বলছে আমেরিকা, অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রিকশায় বাড়ি ফিরছে রংপুরের হারাগাছের বানুপাড়ার গেরস্ত বউ, নিউইয়র্কে কবর খুঁড়ছে বুলডোজার—এগুলোই এখন ‘নতুন নিয়ম’ বা ‘নিউ নরমাল’।
নতুন আসবে বলেই জীবন জীবিত থাকে, মারা যায়… মৃত্যু তো জীবনেরই এক অনন্য উদ্ভাবন। মৃত্যু তো একদিন সূর্যেরও হবে… কিন্তু এ কেমন মৃত্যু!
নতুন করে হারানোর কিছু নেই!
‘শ্বেত-শ্রেষ্ঠত্ব’–এর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে করোনা, আঘাত করেছে পশ্চিমা জাত্যভিমানে। এটা পুরোনো খবর, নতুন খবর হলো—এর মধ্যে মাত্র একজন সাধারণ ‘কৃষ্ণ-মানুষ’কে হত্যার প্রতিবাদে জ্বলছে গোটা আমেরিকা! কথা উঠেছে ১৯১৫ সালে বানানো ‘বার্থ অব দ্য নেশন’–এর মতো নির্বাক যুগের এপিক ছবি নিয়ে, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে ১৯৩৯ সালে বানানো আরেক এপিক ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’। ডি ডব্লিউ গ্রিফিতের ‘বার্থ অব দ্য নেশন’কে চলচ্চিত্র ভাষা তৈরির প্রথম মাইলফলক ধরা হয় পশ্চিমা চলচ্চিত্র পাঠে। আর মুনাফা যদি মাপকাঠি হয় এবং মুদ্রাস্ফীতিকে যদি হিসাবে নেওয়া হয়, তাহলে ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ হবে বাণিজ্যিকভাবে সর্বকালের সফলতম ছবি। কিন্তু ছবি যদি শুধু ভাষা বা মুনাফার বিচারে হিসাব হতো তাহলে আজকে ৮০-১০০ বছর পরে এ নিয়ে কথা উঠত না। অন্তত যখন মহামারি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাদাদের সরদার যুক্তরাষ্ট্র, যখন লাখের বেশি মৃত আর ২২ লক্ষাধিক আক্রান্ত, তখন নিশ্চয়ই একটা ‘কৃষ্ণ-মানুষ’, যাঁর প্রপিতামহদের শিকলে বেঁধে জাহাজের পাটাতনে শুইয়ে প্রশান্ত পাড়ি দিয়ে নিয়ে এসেছিল এই সাদারাই, তাঁর মৃত্যুতে এত কথা উঠত না! এখন কথা উঠেছে, কারণ, তিন থেকে ছয় মাস গৃহবন্দী সারা পৃথিবীর মানুষ, রাতদিন খবরে দেখছে মৃত্যুর মিছিল। এখন কথা উঠেছে, কারণ, মানুষ দেখছে ধনীদের চেয়ে গরিব মারা যাচ্ছে বেশি, মার্কিন মুলুকে সাদাদের চেয়ে কালো। একেকটা মৃত্যু হয়ে যাচ্ছে নিতান্তই পরিসংখ্যানের একটা সংখ্যামাত্র, যদি না আপনি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কেউ না হন! নামগোত্রহীন শবের এই যে কাফেলা, এই দেখতে দেখতে মৃত্যুভয় ভুলে গেছে মানুষ! শত শত বছর ধরে চলে আসা সাদা আর কালোর এই যে বিভেদ, পূর্ব আর পশ্চিমের, উত্তম আর অধমের এই যে ঔপনিবেশিক প্রকল্প, তার গোঁড়ায় কুড়াল মেরেছে করোনা। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির পাঠ তাই নতুন করে নিচ্ছে আজকের মানুষ, পৃথিবীটাকে দেখছে নতুন করে। পথে নামছে তাই হাজারে হাজার, দিনের পর দিন, কারণ, তারা বুঝে গেছে তাদের আর নতুন করে হারানোর কিছু নেই! প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে এই প্যানডেমিক মহামারি করোনা!
একটা নিরপরাধ প্রশ্ন
সিনেমা কিন্তু সমাজ বা রাজনীতির বাইরের কিছু নয়। যেকোনো দেশ বা জাতির স্মৃতিকোষ একেকটা সিনেমা, সময়ের ছাপচিত্র বলা যায় একেকটা সিনেমাকে। তাই ‘সভ্য-সাদা’দের অভ্যস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বানানো ‘বার্থ অব দ্য নেশন’ বা ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’-এর মতো একেকটা ছবি একেকটা ছাপচিত্রের মতো তাদের অসভ্য অতীতেরই সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই এসব ছবিতে কালো মানুষের ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ বা উপস্থাপন নিয়ে এখন কথা বলছে নতুন প্রজন্ম। বেশ কয়েক বছর হলো এটা হলিউডের নতুন ট্রেন্ড। ২০১৮ সালে প্রথম কালো সুপারহিরো ছবি ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ বানিয়ে সেই ট্রেন্ডকে পুঁজি করে ভালো ব্যবসা করে নিয়েছে ডিজনি আর মার্ভেল। যদিও সেটাকে কোনোভাবেই ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ দ্বারা উৎসাহিত কোনো ছবি বলা যায় না, বরং কালোদের ব্যবহার করে প্রচলিত সস্তা সুপারহিরো ফর্মুলার ছবির রি-প্রোডাকশন মাত্র ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’। এর সবচেয়ে খারাপ দিকটা ছিল এর নাম। ষাটের দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া এবং পরে বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়া জনপ্রিয় আন্দোলন ব্ল্যাক প্যান্থারের নাম চুরি করে বানানো ছবিটা ছিল এই আন্দোলনের ভাবাদর্শের পুরোপুরি উল্টো। এখন গুগলে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ লিখে সার্চ দিলে আর সেই তোলপাড় করা আন্দোলনের কিছু আসে না প্রথমে, আসে ২০১৮–এর ডিজনির ‘সফল’ এই ছবির খবর। কালচারাল হেজিমনির এই বিশ্বায়ন প্রকল্পে আমরাও কি খুব নিরাপদ? কয়েক দিন আগে নেটফ্লিক্সের ‘এক্সট্রাকশন’ সিনেমায় ভারত আর বাংলাদেশের তুলনামূলক উপস্থাপনার কথাই ভাবুন। ভারতীয় ছবিতে অবশ্য অনেক দিন আগে থেকেই বাংলাদেশের আপত্তিকর উপস্থাপন হচ্ছে। খুব বেশি আগে যেতে হবে না, ২০১৮–তে মুক্তি পাওয়া ৬ কোটি রুপি বাজেটে তৈরি এবং ২৫ কোটি রুপি ব্যবসা করা তেলেগু ছবি ‘গুডাচারি’তে বাংলাদেশকে যেভাবে দেখানো হয়েছে ‘এক্সট্রাকশন’ তারই ধারাবাহিকতামাত্র। একটু খবর নিলেই জানা যাবে, শুধু হোলি আর্টিজানের পর না, তারও অনেক আগে থেকেই চলছে এই পশ্চিমা প্রকল্প; যেখানে সোভিয়েত–পরবর্তী নতুন পৃথিবীতে ভারতীয় সংস্কৃতির কারখানা দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিমের বিশ্বস্ত ইজারাদারমাত্র। এই কাজে অবশ্য শুধু পশ্চিমা বা ভারতীয়দের দায়ী করলেই চলবে না, জ্ঞানত বা অজ্ঞানত এই কাজের রসদ আমাদের এখান থেকেই গেছে বা এখনো যাচ্ছে। ২০১৬–এর জুলাইয়ে হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট হামলার অনেক আগেই প্রিয়াঙ্কা চোপড়াখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ ‘কোয়ান্টিকো’তে ঢাকার নাইট ক্লাবে মুসলমান উগ্রবাদীদের বোমা হামলার কথা লেখা হয়েছিল। তখন এই সিরিজের আটজনের লেখক দলে ছিলেন বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া মার্কিন লেখিকা শর্বরী আহমেদ। অথচ ২০১৭ সালে হিন্দু উগ্রবাদীদের ব্যাপারে মাত্র একটা বাক্যের জন্য ভারতে চরম সমালোচনা হয়েছিল ‘কোয়ান্টিকো’র। ক্ষমা চেয়েও সিরিজ বাঁচাতে পারেনি আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি (এবিসি) বা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার মতো তারকা। এরপর বন্ধই হয়ে গিয়েছিল অন্যতম জনপ্রিয় এই সিরিজ! বিশ্বায়িত পৃথিবীতে উগ্রবাদ এক জটিল সমস্যা, বাংলাদেশের চেয়ে ভারত বা ফরাসি দেশে এই সমস্যা অনেক বেশি। কিন্তু কালচারাল ন্যারেটিভে ভারত বা ফরাসি দেশে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হলে তারা ‘ভিকটিম’ আর বাংলাদেশে হলে আমরা ‘অফেন্ডার’—পশ্চিমা তথা ভারতীয় সংস্কৃতি কারাখানার এই প্রকল্প নিয়ে আমরা এখন প্রশ্ন না তুললে কারা তুলবে?
তোমার ঔদ্ধত্য, আমারই প্রশ্রয়
একবার কানে পরিচয় হওয়া এক মার্কিন প্রযোজক এসেছিলেন ঢাকায় নিউইয়র্ক টাইমস–এর বেস্টসেলার একটা উপন্যাস থেকে ছবির প্রস্তাবনা নিয়ে। আমি ‘না’ বলে দিয়েছিলাম শুধু বাংলাদেশের উপস্থাপনা পছন্দ হয়নি উপন্যাসে, সে জন্য। শ্বেতাঙ্গ মার্কিন ইহুদি প্রযোজক হয়তো আশা করেননি একজন বাংলাদেশি নির্মাতার কাছ থেকে ‘না’ শুনবেন। অনেক কষ্টে ডিনার শেষ করে সস্ত্রীক বিদায় নিয়েছিলেন ভদ্রলোক। আরেকবার এক সুইস প্রযোজক এসেছিলেন স্টুডিওতে; নামজাদ চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ভদ্রলোক, সুইস টেলিভিশন আর প্রথম সারির বাংলাদেশি সাহায্য সংস্থার জন্য ছবি প্রযোজনা করেছেন। কথায় কথায় বললেন, তিনি চাইলে বাংলাদেশের নির্মাতাদের লাইন লেগে যাবে। ধন্যবাদ জানিয়ে, হাসি মুখে তাঁকেও ‘না’ বলে শুধু চা খাইয়েই বিদায় করেছিলাম ‘শ্বেত-শ্রেষ্ঠত্বে’ ভোগা এই প্রযোজককে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে তাঁদের এই ঔদ্ধত্য কি আমাদেরই প্রশ্রয় না? বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বেড়ে উঠে আমরা দেশে স্বীকৃতি না পেলে বিদেশে চলে যাই, আজেবাজে কোনো একটা তকমা লাগাতে পারলে উদ্ধার হয়ে যাই। রংপুর বানুপাড়ায় আমাদের চোখ যায় না সময়ের সাব-অলটার্ন নায়িকার রিকশায় অক্সিজেনযাত্রা। আমরা শুনতে পাই না আম্পানে ভেঙে যাওয়া বাধে হাজারো পানিবন্দী মানুষের চিৎকার। বিশ্বায়িত সংস্কৃতির আগ্রাসনে ভুগতে ভুগতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে আমরা ঢালিউড শেষ করে যাই টালিউডে, নাহয় বলিউডে—ব্যাংকেবল স্টারের খোঁজে! ভারতের একজন মেয়াদোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র তারকাকে আমরা গণমাধ্যমে যেভাবে উপস্থাপন করি, তার দশ ভাগের এক ভাগ সম্মানও কি আমাদের গুণী তারকারা তাঁদের কাছে পান? এটাই বিশ্বায়িত সংস্কৃতির রাজনীতি। আমাদের রাজনীতিকদের দিল্লির দিকে তাকিয়ে থাকা, বুদ্ধিজীবীদের কলকাতার দিকে তাকিয়ে থাকা আর সংস্কৃতিকর্মীদের মুম্বাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা—এই তিন একই সূত্রে গাঁথা—পশ্চিমের কাছে মাথা নত করা পোস্ট-কলোনিয়াল হীনম্মন্যতা।
হারিয়ে গেলে ফিরব না
ছবি নিয়ে প্রথম উৎসবযাত্রা ছিল বার্লিনে, তখনো নির্মাতা হিসেবে কোনো পরিচয় হয়ে ওঠেনি আমার। সেই বছর ‘শুনতে কি পাও!’ ছিল সম্পাদনা ল্যাবের ছয়টি ছবির মধ্যে। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে মালপত্র ফেলেই ছুটে গিয়েছিলাম উৎসব প্রাঙ্গণে, রেজিস্ট্রেশন তাঁবুতে। নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয়ে একগাদা প্রকাশনা হাতে ধরিয়ে দিল সোনালি চুলের তরুণ স্বেচ্ছাসেবক, সঙ্গে একটা আইডি কার্ড। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছি, আর স্বেচ্ছাসেবক একটানা বলে যাচ্ছে কোথায় গেলে কী পাওয়া যাবে, কোথায় গেলে কী খাওয়া যাবে ইত্যাদি। ছবি নিয়ে প্রথম উৎসবে, তা–ও বার্লিনে—তাঁর কথায় মনোযোগ ছিল না, হু-হা করে দেখছিলাম চারপাশ। হঠাৎ একটা কর্কশ গলায় চমক ভাঙল, মাথা ঘুরিয়ে দেখি স্বেচ্ছাসেবক অতিকষ্টে মুখে হাসি ধরে রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে আমাকে, ‘কার্ডটা গলায় দাও, হারালে আর ঢুকতে পারবে না। ভুলে যেয়ো না, এটা তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা!’ আমি প্রথমে ভাবলাম হয়তো ঠাট্টা করে বলছে, কিন্তু ওর মুখ-চোখ দেখে বুঝলাম সে সত্যিই বলেছে কথাটা। আমার হাসি থেমে গেল, আমি ঠাণ্ডাভাবে উত্তর দিলাম, ‘চিন্তা কোরো না, হারিয়ে গেলে আমিও আর ফিরব না।’ বার্লিনে সেবার ছিলাম দশ দিন, আলোচনায়, আড্ডায় চমৎকার একটা সময় কেটেছে। এরপর আরও অনেক উৎসবে গিয়েছি, আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণে হেঁটেছি কানের লাল গালিচায়, পুরস্কৃত হয়েছি চলচ্চিত্রের বিশ্বমঞ্চ লোকার্নোর পিয়াতজা গ্রান্দায়, কিন্তু বার্লিনের প্রথম ধাক্কাটা খুব কাজে লেগেছিল, তারপর থেকে যেখানেই যাই, প্রথমে পড়ার চেষ্টা করি তাঁদের শরীরী ভাষা, কথা বলি চোখে চোখ রেখে। সবার না হলেও হঠাৎ হঠাৎই কারও চোখে দেখি সেই অপ্রকাশিত জ্বালা, আর মুখ-চোখ শক্ত করে মনে মনে বলি, হারিয়ে গেলে ফিরব না।
একটি কৃষ্ণ জাহাজের গল্প
একটা চমৎকার উৎসবে গিয়েছিলাম একবার ফরাসি দেশের দক্ষিণে নন্ত নামের এক বড়লোক বন্দর শহরে। ‘ফেস্টিভ্যাল অব থ্রি কন্টিনেন্টস’—লাতিন আমেরিকা, এশিয়া আর আফ্রিকা—এই তিন মহাদেশের ভালো ভালো সব ছবি নিয়ে প্রতিবছর বসে এই উৎসব। অনুষ্ঠানের ফাঁকে শহর ঘুরে বেড়াই, আর মোড়ে মোড়ে দেখি দেড়-দুই শ বছরের পুরানো সুন্দর সুন্দর ভবন, অনেকগুলোর বাইরে আবার পাথরে খোদাই করা সাল—সতেরো শতক থেকে উনিশ শতকের। রাতের বিশেষ ডিনারে সজ্জন উৎসব পরিচালকের কাছ থেকে জানলাম, আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ধরে আনা মানুষদের দাস হিসেবে আমেরিকায় পাঠানোর অন্যতম বন্দর ছিল এই নন্ত। সতেরো শতকের শেষভাগ থেকে উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত মাত্র দেড় শ বছরে শুধু এই শহর থেকেই প্রায় ১ হাজার ৮০০ বার প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পাচার করা হয়েছে পাঁচ লক্ষ ‘কৃষ্ণ-মানুষ’কে আমেরিকায়। আজকের বিশ্বে অন্যতম ধনী বলে বড়াই করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাদের শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত তৈরি হয়েছে এই লাখ লাখ ‘কালো’ মানুষেরই জীবন কেড়ে নিয়ে, যৌবন চুরি করে। তাদেরই কারও উত্তরাধিকার আজকের জর্জ ফ্লয়েড আর তাঁর হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নামা হাজারো মানুষ।
নন্ত থেকে ফিরে আসি প্যারিসের উপকণ্ঠে, ফরাসি প্রযোজকের সঙ্গে তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে থাকার কথা ছিল দুই-তিন দিন। উদ্দেশ্য একসঙ্গে থেকে ছবির চিত্রনাট্য আর প্রযোজনা নিয়ে কাজ করা। ছোটখাটো প্রাসাদ সমান দেড় শ বছরের পুরোনো তিনতলা বাড়ি, সামনে সুন্দর বাগান, তার একপাশে নতুন সংযোজন সুইমিং পুল। সন্ধ্যায় ডিনারে প্রযোজকের সদালাপী দম্পতি-বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হতেই চমকে গেলাম, তাঁরা মাত্র এক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে ফিরেছে। তাঁর আগে পাঁচ বছর বাংলাদেশেই কাজ করেছে এক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায়। কথায় কথায় নিজেরাই জানালো, বাংলাদেশ থেকে ফিরেই বাড়িটা কেনা। মুখে হাসি ধরে রেখে খাওয়া শেষ করলাম, আর তিন দিন ঘুরে ঘুরে ভাবলাম, এখনকার শ্রম বাজারে যে বাড়ি বানাতে খরচ হবে রাজসিক, মাত্র পাঁচ বছর বাংলাদেশে চাকরি করেই কিনে নিয়েছে সেই বাড়ি। সুইডেনে গিয়েছিলাম আরেকবার আরেক উৎসবে, অনুষ্ঠান শেষে বন্ধুরা নিজেদের স্পিডবোটে করে স্টকহোম লেক পাড়ি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এক নির্জন দ্বীপে, তাঁদের বাগানবাড়িতে। ছোট্ট সুন্দর দ্বীপ, হাঁটার পথে পথে পড়ে আছে গাছপাকা সবুজ আপেল, গোটা দ্বীপে মাত্র বিশটা বাগান বাড়ি, প্রতিটা বিশাল জমিজমাসহ। এখানেও একই ঘটনা, বন্ধুবৎসল দম্পতি বাংলাদেশে পাঁচ বছর সাহায্য সংস্থায় কাজ করে ফিরে স্টকহোম শহরে কিনেছে দুটো অ্যাপার্টমেন্ট আর এই বাগানবাড়ি। একটা মজার কথা মাথায় এল, এখন আর তাহলে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে জাহাজে বেঁধে কাউকে নিয়ে যেতে হয় না; এখন আমরাই ডেকে আনি তাঁদের। এখন ফ্রান্স আর সুইডেনের মতো অন্যতম ধনী দেশের মানুষ, তুলনামূকভাবে দরিদ্র দেশ বাংলাদেশে এসে সাহায্য সংস্থায় কাজ করে ধনী হয়ে ফিরে যায়।
এখন অন্ধ চিলেদের সময়
২০১৭ সালের সড়ক আন্দোলনের সময় একটা স্যাটায়ার খুব মন কেড়েছিল, শত শত বিদ্রোহী কিশোরদের মাঝখানে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী, হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘দিনাজপুরে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন’। গত দশ বছর ধরেই দেখছি উন্নয়নের বাম্পার ফলন; ৫০তম বিজয় উৎসব করতে যাচ্ছে যেই দেশ, সেই দেশে বিশেষায়িত কয়েকটা হাসপাতালের বাইরে করোনা চিকিৎসার হাল কতটা বেহাল, তা প্রতিবেলার খবরেই দেখা যাচ্ছে। সেই আড়িয়াল খাঁও নেই, বদর মাঝিও নেই, তাই ‘বদর! বদর!’ বলে এখন আর কেউ ডাকে না—সবাই যে যার মতো থাকে, নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর। ফেসবুকে দেখি বিষণ্ণ চেহারায় রঙের পালিশ আর বাহারি রান্নার ডিস, ছবির নিচে ক্যাপশান ‘নিউ শেফ ইন দ্য টাউন!’ মাঝরাতে নির্ঘুম হাঁসফাঁস, সিলিংয়ে সুশান্তের লাশ! হাজারটা প্রশ্ন কুরে কুরে খায় মাথা, আর ঘুরপাক খায় একটা অন্ধ চিল। ছোটবেলায় মন খারাপ হলেই ছাদে চলে যেতাম! ভরদুপুরে কি বিকেল—মাথা তুলে হা করে আকাশের গভীরে খুঁজতাম চিল, পেয়েও যেতাম! তারপর তাকিয়ে থাকতাম একদৃষ্টে! চিলটা ঘুরছে, সঙ্গে আমিও ঘুরছি। মনে মনে ভাবতাম, চিলটা কি অন্ধ? ও কোথাও চলে যায় না কেন? বড় হয়ে আর ছাদে যাওয়া হয় না, আকাশের চিলেদের সঙ্গে অন্ধ হয়ে যাওয়া যায় না। এখন বুঝি, বড় হয়ে গেলে চোখ খুলে দেখতে হয়, দায়িত্ব নিতে হয় সময়ের—তৈরি করতে হয় ভবিষ্যতের রক্ষাকবচ।
লেখক: পরিচালক, চিত্রগ্রাহক এবং স্থপতি
[email protected]