দেখতে পারেন খাবার নিয়ে বানানো সিনেমাগুলো

দেখতে পারেন খাবার নিয়ে বানানো সিনেমাগুলো। ছবি: সংগৃহীত
দেখতে পারেন খাবার নিয়ে বানানো সিনেমাগুলো। ছবি: সংগৃহীত

শুধু রান্না করলেন আর খেয়ে ফেললেন, খাবার বিষয়টা ঠিক এ রকম নয়। খাবারের পেছনে জড়িয়ে থাকে একটি অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি, কৃষিবিজ্ঞান, রসায়ন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, অভিবাসন ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাবারের সঙ্গে মিশে থাকে মানুষের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব–সংঘাতের গল্প। করোনাকালের এই স্থবির সময়ে ঘরে বসে দেখতে পারেন খাবার ঘিরে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যময় গল্পের সেসব চলচ্চিত্র।

করোনার জন্য লকডাউন না হলেও পাহাড়ে একটা লকডাউন হয়েছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভূমিধস আর ভূমিকম্পে দার্জিলিংয়ের একটি পাহাড়ে নিজেদের বাড়িতে আটকা পড়েছিল ছুটি কাটাতে আসা একটি পরিবার। লোকালয়ের সঙ্গে সব যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পরিবারটির। এদিকে ঘরের খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার পথে। এক প্লেট খাবার কমে আধা প্লেট হয়ে যায় ক্রমশ। প্লেট বাদে পরে পিরিচে আসতে থাকে খাবার। এ সময় প্রতিটি চরিত্রের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ভুলে থাকা দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেতে শুরু করে। এমন একটা গল্প লিখেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘নিশিযাপন’ নামের সিনেমা। দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে, সব্যসাচী চক্রবর্তী, রাইমা সেন, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। পরিচালনা করেছিলেন সন্দীপ রায়।

‘দ্য হান্ড্রেড ফুট জার্নি’ সিনেমার গল্প তৈরি হয়েছে মুম্বাইয়ের খাদাম পরিবারকে নিয়ে। ছবি: সংগৃহীত
‘দ্য হান্ড্রেড ফুট জার্নি’ সিনেমার গল্প তৈরি হয়েছে মুম্বাইয়ের খাদাম পরিবারকে নিয়ে। ছবি: সংগৃহীত

‘নিশিযাপন’–এর পর দেখতে পারেন ‘মাছের ঝোল’। ২০১৭ সালে প্রতীম দাশ গুপ্ত পরিচালিত এ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। বাবার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাতে চাকরি ও বাড়ি ছেড়ে দিয়ে শেফ হয়ে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দেব ডির কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। দেব ডির পারিবারিক মান–অভিমান, ২৫ বছর আগে খাওয়া মাছের ঝোলের স্মৃতি, বাঙালি বউ, অপরিচিত সন্তান, ফ্রেঞ্চ বান্ধবী, নাছোড়বান্দা উঠতি সাংবাদিক, উঠতি শেফ—এ রকম অনেক চরিত্র মাছের ঝোলে মাখামাখি হয়ে আপনার দর্শক মনে অনুরণন তুলবে। এতে অভিনয় করেছেন ঋত্বিক চক্রবর্তী, পাওলি দাম, মমতা শঙ্কর, অর্জুন চক্রবর্তী, সৌরসেনী মৈত্র প্রমুখ। এর সঙ্গে দেখতে পারেন রসগোল্লার জন্ম ইতিহাস নিয়ে বানানো ‘রসগোল্লা’ চলচ্চিত্রটি। রসগোল্লার জনক নবীন চন্দ্র দাসের জীবনী নিয়ে বানানো এ চলচ্চিত্রটি ২০১৮ সালে মুক্তি পায়। এটির পরিচালক পাভেল। অভিনয় করেছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, উজান গাঙ্গুলি, আবন্তিকা বিশ্বাস, কৌশিক সেন প্রমুখ। রসগোল্লার ইতিহাস হয়তো আপনি আরও অনেক পাবেন। এই চলচ্চিত্রে খরাজ কিংবা রজতাভ দত্তের অভিনয় মুগ্ধতা ছড়াবে।

দেখতে পারেন রসগোল্লার জন্ম ইতিহাস নিয়ে বানানো ‘রসগোল্লা’ চলচ্চিত্রটি। ছবি: সংগৃহীত
দেখতে পারেন রসগোল্লার জন্ম ইতিহাস নিয়ে বানানো ‘রসগোল্লা’ চলচ্চিত্রটি। ছবি: সংগৃহীত

লোকাল কেরালা পরোটার সঙ্গে স্প্যানিশ অমলেটের যুগলবন্দী কেমন হতে পারে? ‘ওস্তাদ হোটেল’ নামের মালায়লাম চলচ্চিত্রটি দেখলে সেটা বুঝতে পারবেন। এই চলচ্চিত্রটির একটি সংলাপ খুব বিখ্যাত। মালায়লাম থেকে ইংরেজি কিংবা হিন্দি হয়ে বাংলা করলে সংলাপটির অর্থ দাঁড়ায়, ‘যে কেউ যে কাউকে খাবার দিতে পারে। কিন্তু আমাদের কাজ অন্যকে হৃদয় দিয়ে তৃপ্ত করা।’ এ চলচ্চিত্রটির বড় বৈশিষ্ট্য, জীবন ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাবারের মেলবন্ধন ঘটানো। ২০১২ সালের চলচ্চিত্র এটি। আনোয়ার রশিদের পরিচালনায় এতে অভিনয় করেন দুলকার সালমান, কে সুরেন্দ্রনাথ থিলাকান, নিত্যা মেনন, সিদ্দিক, অসীম জামাল প্রমুখ।

‘বুড়ো আজ একাই পৃথিবী থেকে যায়নি। চিকেন খোরানারও মৃত্যু হয়েছে।’ ‘লভ শুভতে চিকেন খুরানা’ ছবিতে এ সংলাপ শুনতে পাবেন। কমেডি ঘরানার এ সিনেমায় এ সংলাপ আপনাকে মজা দিলেও খাবার ব্যাপারটা কিন্তু এ রকমই। কোনো কোনো মানুষের মৃত্যুতে বিশেষ কোনো খাবারের মৃত্যুও হয়ে যেতে পারে।

‘লাঞ্চবক্স’ দেখতে ভুলবেন না। ছবি: সংগৃহীত
‘লাঞ্চবক্স’ দেখতে ভুলবেন না। ছবি: সংগৃহীত

‘দ্য হান্ড্রেড ফুট জার্নি’ সিনেমার গল্প তৈরি হয়েছে মুম্বাইয়ের খাদাম পরিবারকে নিয়ে, মুম্বাই শহরে যাদের ছিল সচল একটি রেস্টুরেন্ট। কোনো এক নির্বাচন–পরবর্তী সময়ের দাঙ্গায় নিঃস্ব পরিবারটি অ্যাসাইলাম নেয় ইউরোপে। ইংল্যান্ড ঘুরে তারা পৌঁছায় ফ্রান্সে। সেখানে একটি পরিত্যক্ত রেস্টুরেন্ট কেনে এক গ্রামে। সেই রেস্টুরেন্টের ঠিক উল্টো দিকে এক শ ফুট দূরত্বে রাস্তার পাশে ছিল আর একটি ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্ট। জীবনের তাগিদে রেস্টুরেন্টকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া একটি অভিবাসী ভারতীয় পরিবার, অন্যদিকে খাবারের ঐতিহ্য–সচেতন ফরাসি রেস্টুরেন্ট মালিক। সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর সংস্কৃতির কিছু মানুষ একই জনপদে টিকে থাকার লড়াই শুরু করে দুটি রেস্টুরেন্টকে কেন্দ্র করে। লাসে হলস্ট্রোম পরিচালিত এই হলিউড মুভিটিতে অভিনয় করেছেন ওমপুরী, হেলেন মিরেন, মনীশ দয়াল, শার্লট লে বন।

গরম চকলেটের সঙ্গে ‘চিলি পেপার’ খেয়েছেন? বেশির ভাগ মানুষই খাননি। ‘চকলেট’ নামের চলচ্চিত্রটি দেখলে চকলেট দিয়ে তৈরি এমন অনেক খাবারের কথা জানতে পারবেন। কিন্তু এই চলচ্চিত্রটি কেবল চকলেট দিয়ে তৈরি করা খাবারের জন্যই বিখ্যাত নয়। দক্ষিণের বাতাসকে অনুসরণ করে ১৯৫৯ সালে ভিয়ানি রচার এবং তার ছয় বছরের মেয়ে অনুক ফ্রান্সের একটি ছোট্ট শহরে এসে চকলেট শপ খুলে বসে। বরফ পরা শীতের দিনে এই চকলেট শপ বা চকলেটটি হয়ে ওঠে মেয়রশাসিত সেই ছোট্ট শহরের মুক্তির কেন্দ্র। পুরুষ মেয়রশাসিত ছোট্ট সে শহরটিতে ক্রমেই শেষ হতে থাকে মেয়রের একচ্ছত্র আধিপত্য। ড্রামা জনরার এ চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেন জুলিয়েট বিনোস, জুডি ড্যান্স, জনি ডেপ, আলফ্রেড মলিনা প্রমুখ। পরিচালনা করেন লাস হ্যালসট্রম।

‘ওস্তাদ হোটেল’ নামের মালায়লাম চলচ্চিত্রটি দেখলে সেটা বুঝতে পারবেন। ছবি: সংগৃহীত
‘ওস্তাদ হোটেল’ নামের মালায়লাম চলচ্চিত্রটি দেখলে সেটা বুঝতে পারবেন। ছবি: সংগৃহীত

‘শেফ’ একটি আক্ষরিক অর্থে ‘ক্রেজি’ এবং অনুপ্রেরণামূলক চলচ্চিত্র। একজন শেফ মূলত একজন শিল্পী। এই শিল্পীর সঙ্গে যখন অর্থবিত্তের সংঘাত তৈরি হয়, তখন শিল্পীকে নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হয় সম্ভবত। মায়ামিতে জন্ম নেওয়া কার্ল ক্যাস্পার লস অ্যাঞ্জেলেসের ব্রেন্টউডের গুলুয়াজ নামের একটি জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টের হেড শেফ। তার সঙ্গে রেস্টুরেন্টের মালিকের দ্বন্দ্ব শুরু হলে চাকরি ছেড়ে নিজের কিশোর ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ফুড ট্রাক তৈরি করে ফেলে ক্যাস্পার। এরপর দাপিয়ে চলে তার খাবার বানানোর কাজ, বিশেষ করে কিউবান খাবার। এই পুরো জার্নিতে কার্ল ক্যাস্পারের সঙ্গী হয় তার সাবেক সহকর্মী টনি। ক্রমে কার্ল একটি রেস্টুরেন্টের অংশীদার হয়ে ওঠে, যেখানে খাবার তৈরির পুরো স্বাধীনতা তার। ২০১৪ সালের কমেডি ড্রামা ঘরানার এ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন জন ফ্যাভরিউ। অভিনয় করেন পরিচালক জন ফ্যাভরিউ নিজে আর সঙ্গে ছিলেন জন লেগুইজামো, সোফিয়া ভেরগারা, এমজয় অ্যান্টনি প্রমুখ।

এই চলচ্চিত্রগুলো ছাড়াও দেখতে পারেন, ‘রাটাটুলি’ নামের দুর্দান্ত অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রটি। রেমি নামের স্বাদ এবং গন্ধ বোঝার ক্ষমতাধর ইঁদুরটির তেলেসমাতির কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ২০১৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কুক আপ আ স্টর্ম’ নামের হংকং চায়নিজ কালিনারি ড্রামা মুভিটিও দেখতে পারেন। এতে পাবেন দুই ভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা দুই তরুণ শেফের দ্বন্দ্বের গল্প। দেখতে পারেন ‘কুং ফু শেফ’। এটি ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া হংকং চায়নিজ অ্যাকশন মুভি। হিন্দি ছবি ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া কমেডি ড্রামা ঘরানার ছবি ‘রামজি লন্ডওয়ালা’ও দেখতে পারেন। যাঁরা অভিনেতা মাধবনে মজে ছিলেন একটা সময়, তাঁরা এই সময়ে আবারও স্মরণ করতে পারেন তাঁকে। ‘নো রিজার্ভেশন’ নামের ইংরেজি ছবিটিও দেখে ফেলুন এই ফাঁকে। মজা পাবেন।

২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া হংকং চায়নিজ অ্যাকশন মুভি ‘কুং ফু শেফ’ দেখতে পারেন। ছবি: সংগৃহীত
২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া হংকং চায়নিজ অ্যাকশন মুভি ‘কুং ফু শেফ’ দেখতে পারেন। ছবি: সংগৃহীত

আর হ্যাঁ, ‘লাঞ্চবক্স’ দেখতে ভুলবেন না। দেখেছেন নিশ্চয়ই আগে। আরও একবার দেখে ফেলুন, ব্যস্ত মুম্বাই শহরের ক্লান্ত চাকরিজীবীদের জন্য বাড়ি থেকে পাঠানো লাঞ্চবক্সগুলো কীভাবে সাইকেল, ট্রেন, ঠেলাগাড়িতে করে নির্দিষ্ট মানুষের হাতে উপস্থিত হয়। ব্যস্ত শহরে লাঞ্চবক্সকে নিয়ে গড়ে ওঠা পেশাজীবীদের কাজকর্মকে নতুন করে উপলব্ধি করতে পারবেন। সেই সঙ্গে পাবেন এক ব্যতিক্রমী রোমান্টিক গল্প। ইরফান খান, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী ও নিমরাত কাউরের দুর্দান্ত অভিনয় থাকবে সঙ্গে।

খাবার নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্রগুলো উপভোগ করুন এই করোনাকালের ঘরবন্দী অবস্থায়। আর সুযোগ থাকলে রেঁধে ফেলুন নতুন নতুন খাবার।