'নাটকটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না'
>কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের কোথাও কেউ নেই ধারাবাহিক নাটকে বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। বহু বছর পর আবারও নাটকটি প্রচার করছে বাংলাদেশ টেলিভিশন। মানুষকে ঘরে বসে সময় কাটানোর জন্য উৎসাহিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে চ্যানেলটি। এই সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব জানালেন এই নাটক নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ও সাম্প্রতিক মহামারিতে দুস্থদের জন্য নেওয়া উদ্যোগসহ নানা কথা।
কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন?
বই পড়ে, টেলিভিশন ও সিনেমা দেখে। আমি, আমার স্ত্রী, মেয়ে, জামাই একসঙ্গে থাকি। সবার সঙ্গে গল্পগুজব করা হচ্ছে। যদিও আমার স্ত্রী ডাক্তার, তিনি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁকে নিয়মিত বাইরে যেতে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটু দুশ্চিন্তার বিষয়ও।
এই দুর্যোগে সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন?
আমরা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণের কাজ শুরু করেছি। আমি নিজে গিয়েছিলাম দুটো স্পটে। প্রথম দিন যাত্রাবাড়ী, দ্বিতীয় দিন দক্ষিণখানে। আমরা নিজেদের মধ্যেই অর্থ সংগ্রহ করে শ্রমজীবী মানুষদের সাহায্য দিয়েছি। আমাদের কাছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কিছু শিল্পীর তালিকা আছে। এ তালিকায় আছেন গ্রামে-গ্রামে গান করে জীবন চালানো শিল্পী, ঢাকায় তবলা বা মন্দিরা বাজানো শিল্পী, মঞ্চের লাইট অ্যাসিস্ট্যান্ট, ডেকোরেটর অ্যাসিস্ট্যান্ট, মেকআপ অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাঁদের পাশাপাশি আছেন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কিছু মঞ্চশিল্পী। শিল্পাঙ্গনের এ রকম দুই শতাধিক মানুষকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমরা অর্থ সহায়তা দিয়েছি। যে অঙ্কটা পাঠাচ্ছি, হয়তো আরও ১০০ জনকে পাঠাতে পারব।
আপনার নির্বাচনী এলাকা নীলফামারীতে কিছু করার সুযোগ হয়েছে?
সেখানে সচেতনতামূলক কাজ দিয়ে আমরা শুরু করেছি। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সচেতন করা, লিফলেট বিলি করার কাজ করেছেন আমাদের লোকেরা। লিফলেট যে হাট-বাজারে বিতরণ করা হচ্ছে, তা নয়। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে একেবারে ওয়ান-টু-ওয়ান বোঝানো হচ্ছে সবাইকে। এ কাজে আমাদের বড় একটা টিম আছে। এ ছাড়া আমরা আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় মাইকিং করেছি, যাতে সাধারণ মানুষ সচেতনতার বার্তাগুলো সহজে বুঝতে পারে। প্রমিত বাংলা ভাষায় মাইকিং করলে গ্রামের মা-বোনেরা সেটা বুঝতে পারতেন না, এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সে জন্য আমরা আঞ্চলিক ভাষায় সচেতনতার বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে মাইকিং করেছি। আবার রিকশা ও মাইক একসঙ্গে চলেছে, সে রকমও না। একেকটা স্পটে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ থেমে তিন–চারবার করে একই জিনিস বাজানো হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। তৃতীয় ভাগে আমরা নিম্ন আয়ের মানুষদের চাল-ডাল, আলু-সাবান বিতরণ শুরু করেছি। চার দিন ধরে এটা চলছে। সমাজসেবা অফিস থেকে আমরা প্রতিবন্ধীদের একটা তালিকা নিয়েছি, যাতে তাঁদের বাসায় চাল-ডাল পৌঁছে দিতে পারি। এ ছাড়া নিম্নমধ্যবিত্তদের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য দুটো মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে। তথ্য যাচাই করে পরিচয় গোপন রেখে তাঁদের সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হবে।
মানুষকে বাসার ভেতরে রাখাই যাচ্ছে না। এই কাজটা কীভাবে করা যেত?
এটা একটা বড় সমস্যা। হাটবাজারগুলোর ক্ষেত্রেও এটা একটা সমস্যা। আমাদের ইপিজেডগুলো কদিন আগেও খোলা ছিল। ইপিজেড যখন ছুটি হয়, শত শত মানুষ গিয়ে বাজারে ঢোকে। একসঙ্গে কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরে। দূরত্ব রাখার বিষয়টি তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যদিও আমাদের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও সেনাবাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করছে। গ্রামের হাটগুলোতে যখন পুলিশ যায়, দেখা যায় সবাই তাড়াহুড়া করে তালা মেরে লুকিয়ে পড়ে। পুলিশ চলে গেলে কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। চায়ের দোকানগুলোর আড্ডা তো কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এত অনুরোধ, এত প্রচার, তবু কাজ হচ্ছে না। আমরা জানি না সামাজিক সংক্রমণ কত দূর পৌঁছেছে। এই যে গার্মেন্টস কর্মীদের নিয়ে যেটা হলো, ঢাকা থেকে লোক বের হয়ে গেল, আবার ঢাকায় ফেরত এল। অনেকে আবারও চলে যাচ্ছে। তারপর ধরা যাক এতগুলো মানুষ যে বিদেশ থেকে এলেন, তাঁদের কতটা মনিটরিং করা হয়েছে, সেটা আমরা সঠিকভাবে জানি না। চেষ্টা করা হয়েছে সর্বাত্মক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার ভাষণ দিয়েছেন, টেলিভিশনে তাঁর কথাগুলো বারবার প্রচার করা হচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্য মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করছে। বিত্তশালীরা এগিয়ে আসছে, পুলিশ সারাক্ষণই আছে, তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী যুক্ত হয়েছে। র্যাব টহল দিচ্ছে, আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা আছে, যুবসমাজ কাজ করছে। তবু মানুষকে ঘরের ভেতরে রাখা যাচ্ছে না। এসবের প্রতিকার কী, জানি না। কারফিউ জারি করতে হবে কি না, সেটাও জানি না। নারায়ণগঞ্জের মেয়র ইতিমধ্যে কারফিউ জারি করার আবেদন জানিয়েছেন।
আমরা কি পারব এই মহামারি জয় করতে?
আমরা পারব। কারণ, এ সময়ে মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর তাগিদ লক্ষ করছি। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে একেবারে তরুণ ছেলে-মেয়েদের ভেতরেও সেই তাগিদ দেখতে পাচ্ছি। রাজনৈতিক নেতারা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান দাঁড়াচ্ছে, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়াচ্ছে, গার্মেন্টসগুলো পিপিই তৈরি করে দিচ্ছে, আমাদের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও আছেন। যদিও কিছু কিছু প্রাইভেট হাসপাতালের বিরুদ্ধে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া মানুষ তো এখন অন্য রোগেও আক্রান্ত হতে পারে। তাহলে হাসপাতালগুলো কেন রোগী নেবে না? পিপিইর জন্য তাদের কেনই–বা সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হবে? তারা তো প্রচুর টাকা আয় করে। নিজ উদ্যোগেই তারা এসব কিনতে পারত, নিজ উদ্যোগেই হাসপাতালগুলোতে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়াতে পারত।
করোনা–পরবর্তী সময়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতা কি আরও বাড়বে?
মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা সামাজিক যে বিশৃঙ্খলা দেখেছি, যে কারণে বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমি লাল ঘোড়া দাবড়ায়ে দিব’...। মানুষকে তিনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলেন না। আমাদের সেই মানসিক অবস্থার কতটা পরিবর্তন হয়েছে, আমি জানি না। আমাদের অনেক রকম উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু সচেতনতা আসেনি। সরকার যেদিন ছুটি ঘোষণা করল, সবাই মিলে তখন কক্সবাজারে যেতে শুরু করল। পুলিশ তখন বাধ্য হয়ে শক্তি প্রয়োগ করে বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন সরিয়েছে। ছুটি দেওয়া হলো, যাতে মানুষ নিরাপদে বাড়িতে থাকতে পারে, সেখানে তারা চলে যাচ্ছে বেড়াতে, পিকনিকে, রেস্টুরেন্টে। এই ক্রাইসিস পার হওয়ার পর কীভাবে সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখার শিক্ষাটা আমাদের মাঝে কাজ করবে, আমি জানি না। তবে একটা বার্তা সারা পৃথিবীর কাছে গেছে, জানি না সেটা কতটা কার্যকর হবে। সেটা হচ্ছে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেই আমাদের বসবাস করতে হবে। প্রকৃতিকে বিরূপ করে আমরা নিজেরা বাঁচতে পারব না। যত ভাইরাস বলি যা কিছু বলি, এগুলো আসছে কীভাবে? বনের জন্তুকে বনে না রেখে শহরের রাস্তায় নিয়ে এলে চলবে না। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ কথাটা বলি আমরা। কিন্তু এখন বন্য প্রাণী ও শিশু—দুটোই রাস্তায়! এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার হলো না। আমাদের প্রকৃতির স্বাভাবিকতায় ফিরতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। আমার বিশ্বাস, আমরা এ যুদ্ধেও জয়লাভ করব।
মঞ্চে কাজ শুরু করেছিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে আপনাকে আবার মঞ্চে পাওয়া যাবে?
মঞ্চের কাজ বন্ধ হয়ে গেল, কী আর করা যাবে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে যদি শারীরিকভাবে ভালো থাকি, তাহলে কাজ করব। আমাদেরও তো বয়স হয়ে যাচ্ছে। আমার এক শ ভাগ ইচ্ছে আছে মঞ্চে কাজ করার।
জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ আবার দেখাচ্ছে বিটিভি। এই ধারাবাহিক আপনার কতটা প্রিয়?
‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিকটি জনপ্রিয় হয়েছিল। জনপ্রিয় মানেই সবচেয়ে ভালো, সেটা বলা যায় না। আমার কাছে যদি জানতে চান, আমার প্রিয় ধারাবাহিক নাটক কোনটি, আমি বলব ‘অয়োময়’। গল্পের গাঁথুনি, গভীরতা, চরিত্রের গভীরতা—সবকিছু মিলে ‘অয়োময়’ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ধারাবাহিক। দুঃখজনক হচ্ছে, এটা সম্ভবত টেলিভিশনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বা নষ্ট হয়ে গেছে। এটাকে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। মানুষ পরে এটা দেখতে পায়নি। ইউটিউবে পাওয়া যায়, কিন্তু সেটি খুবই অস্পষ্ট।