মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বৃন্দাবন ও খুশি দম্পতি
অভিনেত্রী শাহনাজ খুশি ও নাট্যকার বৃন্দাবন দাসের ছিমছাম সংসার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এখন ভালো নেই তাঁরা। যদিও পরিবারের কেউ করোনা–আক্রান্ত নন, কিন্তু ভবিষ্যতের ভাবনায় চিন্তিত এই শিল্পী পরিবার। একদিকে শুটিং বন্ধ, তাই আয়ও বন্ধ। ১৫ দিন ধরে পুরো পরিবার নিজেদের বাসায় আছে। এর মধ্যে মাত্র এক দিন শাহনাজ খুশি বাইরে নেমেছিলেন ওষুধ ও সবজি কিনতে। বৃন্দাবন দাস কোথাও বের হচ্ছেন না। দুই ছেলে পড়েন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁরাও ক্যাম্পাসে যেতে পারছেন না। পারিবারিকভাবে একটা স্থবিরতা কাজ করছে, যা তাঁদের মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে ফেলছে।
প্রথম আলোর ফোন পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শাহনাজ খুশি। তিনি বলেন, ‘পুরো পৃথিবীর কথা চিন্তা করে, দেশের কথা চিন্তা করে মুষড়ে পড়ছি। আগেও এভাবে ঘরে থেকেছি। তবে ওই থাকার মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তা ছিল না। এখন সহ্যশক্তি কমে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ খারাপ করে ফেলছি। বাচ্চারা একটা কথা বললে খারাপ লাগছে। আমি একটা কথা বললে ওরা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এই যে জীবন, এটা কিন্তু ভালো লাগছে না।’
করোনার দিনগুলোতে যাপিত জীবনের চিত্রটা কেমন, সে কথা জানালেন খুশি। ‘বৃন্দাবন সারাক্ষণ পত্রিকা পড়ছে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। ও লিখতে পারছে না। এটা ক্রিয়েশনের সময় নয়। আনলিমিটেড চা খাচ্ছি, রান্না করছি। রাত ১০টার পর সিনেমা দেখি রাত ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত। সন্ধ্যায় চা খেয়ে বৃন্দাবন একটু বই পড়ে। ছেলেরা অনলাইনে সময় কাটায়। ঈদ উৎসবে যে পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো ঘরে করি, এখন সেগুলো করছি। নিয়মিত এগুলো করা হয় না। বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমাদের। কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনা করলে সবাই তাতে অংশ নিতে পারছি। যে কারণে সময় কাটাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। একরকমের রুটিন হয়ে গেছে। খারাপ লাগত না, যদি এই অনিশচয়তা না থাকত’, খুশির কণ্ঠে বেদনার ভার।
খুশি বলেন, ‘আমি যেহেতু আমার বাবার পরিবারের সঙ্গে থাকি না, সেহেতু পুরো বাংলাদেশটাই আমার পরিবার। এই চর্চাটা যারা করেছে, তারা বলতে পারবে। যাদের নিজেদের আপনজন বলে কেউ থাকে না, তাদের সবাই আপনজন হয়ে যায়। যে কারণে হঠাৎ ফোন বাজলে ফোন ধরতে ভয় পাচ্ছি। কলিংবেল বাজলে ভয় পাচ্ছি। দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছি। এর মধ্যেও সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছি। যার যার মতো করে একে অন্যকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। আমি ভেঙে পড়লে বাচ্চারা সান্ত্বনা দিচ্ছে। বাচ্চারা ভেঙে পড়লে বৃন্দাবন ওদের বোঝাচ্ছে।’
দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ-বেদনার পর কথা ওঠে কাজকর্ম নিয়ে। হঠাৎ শুটিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেমন প্রভাব পড়েছে জীবনে? খুশি বলেন, ‘আমি বছরে একটা থেকে দুইটা সিরিয়াল করি। সারা বছর কাজ করি না আমি। ঈদে আমি বেশি কাজ করি। বৃন্দাবনের কাজের জন্য আমি সব সময় কাজ করতে পারি না। বাচ্চাদের দেখতে হয়। আমি শুটিংয়ে গেলে সংসারের কাজ গুছিয়ে যেতে হয়। কখনোই স্থায়ী কাজের লোক ছিল না আমাদের। ১৭ মার্চ থেকে ১৩ মে পর্যন্ত দু–এক দিনের ব্যবধান দিয়ে কাজের শিডিউল ছিল আমার। সেভাবেই সব গুছিয়ে রেখেছিলাম।’
খুশির কথায় তাঁদের পরিবারের অনিশ্চয়তার কথা উঠে আসে। তিনি বলেন, ‘এখন কাজ হারিয়ে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো সম্পদ হারিয়ে ফেলেছি। কাজই আমাদের প্রাণ। আমাদের কোনো চাকরি নেই। কোনো ব্যবসা নেই। নাটকের ওপর আমরা নির্ভরশীল। যারা চাকরি করে, তাদের ছুটি শেষে অফিস খুলবে। মাসের বেতনটা ব্যাংকে পৌঁছে যাবে। আমাদের তা না। আমাদের কাজ করে উপার্জন করতে হবে। অন্ন–বস্ত্রের চিন্তায় পড়ে যাব, বাসস্থানের চিন্তায় পড়ে যাব—কখনো ভাবিনি। সবকিছু ঘুরে দাঁড়াতে কত সময় নেবে জানি না।’
করোনা প্রসঙ্গে খুশি বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে মৃত্যুর সংখ্যা দেখছি আর অস্থির হচ্ছি। সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে। সকাল হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিচ্ছি। করোনার আপডেট নিয়ে তারপর ব্রাশ করতে যাচ্ছি। দিনটা পার করতে হবে, তাই দিনের সময়কে ভাগ করে নিচ্ছি।’
প্রতিদিন দুই–থেকে তিনবার কেঁদে ফেলেন শাহনাজ খুশি। তাঁর আবেগপ্রবণতার কথা জানেন স্বামী ও সন্তানেরা। তাঁরা পরিবারের একমাত্র নারী সদস্যটিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। বলেন, ‘এই দিন পাল্টাবে’। খুশিও জানেন, এই দিন থাকবে না। কিন্তু এই অবস্থা কবে ঠিক হবে, ঠিক হলে কীভাবে হবে, জানা নেই তাঁর। জানা নেই কারোরই।