আতঙ্কিত বিশ্বে বিশ্বনাট্য দিবস আজ
বিশ্বনাট্য দিবস এবার এল এমন এক সময়ে, যখন সারা বিশ্ব এক ভয়াবহ ভাইরাসে পর্যুদস্ত। এর আগে আর কোনো মহামারি এত দ্রুত এত বেশি দেশে একসঙ্গে ছড়িয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। দেশে দেশে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কিন্তু জীবন তো সহজে হার মানে না। ধ্বংস বা বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গাওয়াই তো সংস্কৃতির ধর্ম। আর সে ধর্ম পালনে নাটক সব সময়ই এগিয়ে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিশ্বনাট্য দিবস আমরা আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করতাম। নাট্যকর্মীদের বর্ণাঢ্য র্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সম্মাননা, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বাণী পাঠ, বিশেষ বক্তৃতা, প্রীতি সম্মিলনী সবকিছু মিলিয়ে উৎসবমুখর থাকত দিনটি। কিন্তু এবার আমরা স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে কোনো জমায়েত বা অনুষ্ঠান না করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দিনটির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করছি। আমরা নাটক করি মানুষের জন্য, তাই আগে মানুষের নিরাপত্তা, তারপর বাকি সব।
এবারের বিশ্বনাট্য দিবসেই আমরা সূচনা করতে পারি বর্তমান করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নানা স্বেচ্ছাসেবী কাজ। সতর্কতার সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবাণুনাশক ছিটানো, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করা, মাস্ক ও জীবানুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে তা সবার মাঝে বিতরণ করা, মানুষকে সচেতন করা, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মতো কাজ আমরা করতে পারি। কেউ কেউ ইতিমধ্যে কাজ শুরুও করে দিয়েছেন। সব জাতীয় বিপর্যয়ে অতীতের মতো সংস্কৃতিকর্মীরা এগিয়ে আসবেন, এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
বিশ্বনাট্য দিবসের প্রবক্তা যে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটিআই),Ñতারও প্রতিষ্ঠা ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রচেষ্টা হিসেবে। আইটিআই-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রদর্শনকলার ক্ষেত্রে চর্চা ও জ্ঞানের আন্তর্জাতিক বিনিময় প্রসার, নাট্যজনদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সৃজনশীলতায় উৎসাহদান, উন্নয়ন ভাবনায় শৈল্পিক সৃজনশীলতাকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনমত পুষ্ট করা, জনগণের মধ্যে শান্তি ও মৈত্রী বাড়াতে পারস্পরিক সমঝোতা গভীরতর করা, ইউনেসকোর লক্ষ্যে ও আদর্শ সুরক্ষায় অবদান রাখা।
আইটিআই-এর সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্তির বয়সও আজ ৩৮ বছর পূর্ণ হলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইটিআই কংগ্রেসে বা অন্যান্য উপলক্ষে যখন আমরা বিভিন্ন মহাদেশের নাট্যজনদের সঙ্গে মিলিত হই, তখন আমাদের ভাবনার দিগন্তে দোলা লাগে। আইটিআই-এর সঙ্গে যুক্ত না থাকলে আমরা কি মিলতে পারতাম এসব মানুষের সঙ্গে অথবা এত দেশের নাট্যবিদরা কি আসতেন আমাদের বাংলাদেশে, দেখতেন আমাদের নাটক, ভাববিনিময় করতে পারতেন আমাদের নাট্য নির্মাতাদের সঙ্গে? ধন্যবাদ আইটিআই, আমাদের বিশ্ব নাগরিকত্বের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য।
পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের সঙ্গে আমাদের নাটকের একটা পার্থক্য আছে। আমাদের কার্যকারণের ভিন্নতা আছে। নাটকের মধ্যে আমরা জীবনের অর্থ খুঁজে পাই। নাটক একদিকে আমাদের শিল্পবোধ প্রকাশের মাধ্যম, অন্যদিকে প্রতিবাদের ভাষা। নাটক নিয়ে আমরা যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছি। প্রাপ্তি নিয়ে আমরা ভাবি না, নিজেদের আনন্দই বড়। সে আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে সামাজিক দায়বদ্ধতা।
১৯৬১ সালের জুনে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আইটিআই-এর নবম কংগ্রেসে বিশ্বনাট্য দিবস প্রবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। দিন-তারিখ নির্ধারণ করার প্রশ্ন উঠলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পরবর্তী বছর (অর্থাৎ ১৯৬২ সালে) প্যারিসে অনুষ্ঠেয় থিয়েটার অব নেশনস উৎসবের সূচনার দিনটি (২৭ মার্চ) প্রতি বছর বিশ্বনাট্য দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হবে।
১৯৬২ সাল থেকে দুনিয়াজুড়ে বিশ্বনাট্য দিবস পালনোৎসব ক্রমে ব্যাপকতা অর্জন করে চলেছে। প্রতি বছর ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট নাটক কিংবা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানায় এ উপলক্ষে আন্তর্জাতিক বাণী প্রদানের জন্য। বিশ্বনাট্য দিবসের প্রথম বাণীর রচয়িতা জাঁ ককতো। বিগত চার দশকে বিশ্বের মহান চিন্তকরা এই বাণীর মধ্য দিয়ে গোটা নাট্যমণ্ডলীর সঙ্গে তাঁদের থিয়েটারবিষয়ক ভাবনা ও কল্পনা ভাগ করে নিয়েছেন। স্যাটেলাইট এবং অন্যান্য শ্রবণ-দর্শন মাধ্যমের বর্ধমান আগ্রাসন সত্ত্বেও তাঁদের সবাই মঞ্চের ক্ষমতা বিষয়ে আস্থা ব্যক্ত করেছেন। এই সব ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ভাষার প্রতিনিধিত্ব করছেন, কিন্ত তাঁরা সবাই মানব সমাজে শান্তি ও সমঝোতা আনতে সংলাপের শক্তিতে আস্থাবান। সমকালীন বিশ্ব নাটক ও শিল্পের মহান ব্যক্তিত্ব স্যার লরেন্স অলিভিয়ার, জাঁ-লুই বারো, আর্থার মিলার, হেলেনা ভাইগেল, পিটার ব্রুক, পাবলো নেরুদা, ইউজিন আয়োনেস্কো, ওলে সোয়িঙ্কা, এডওয়ার্ড অ্যালবি, গিরিশ কারনাড, আরিয়ান মুশকিন, রিচার্ড বার্টন, ভাসলাভ হাভেল, অগাস্তো বোয়াল প্রমুখ বিশ্বনাট্য দিবসের বাণীতে জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছেন থিয়েটারের আদর্শ ও তার প্রয়োজনীয়তা।
এবারে বিশ্বনাট্য দিবসের আন্তর্জাতিক বাণী দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রগতিশীল নাট্যকার শাহিদ নাদিম, যিনি তাঁর স্ত্রী মাদিহা গওহরের সঙ্গে মিলে লাহোরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আজোকা থিয়েটার। নাদিমের প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে কারাগারে অন্তরীণ করেছিল। সেখানেও তিনি ছোট ছোট নাটিকা লিখে বন্দীদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। শাহিদ নাদিম তাঁর বাণীতে লিখেছেন:
‘আজকের দুনিয়ায় ঘৃণা, সহিংসতা ও গোঁড়ামি বৃদ্ধি পাচ্ছে, পৃথিবী ক্রমেই জলবায়ু
বিপর্যয়ের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় আত্মিক শক্তি জোরদার করা বিশেষ
প্রয়োজন। যে পৃথিবী আমাদের আবাস, যে-মহাবিশ্বের আমরা অংশী, তার প্রতি
ঔদাস্য, অবহেলা, লালসা, হতাশা ও অবজ্ঞার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে।
এ ক্ষেত্রে থিয়েটারের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা, মহান দায়িত্ব, সংকটের অতলে তলিয়ে
যাওয়া থেকে উদ্ধার পেতে মানবতার বোধ সংহত ও শক্তিশালী করা। থিয়েটার পারে
মঞ্চ ও পরিবেশনার পরিসরকে পবিত্র ভূমিতে রূপান্তর করতে। ... নাটকের রয়েছে
উপাসনালয় হয়ে-ওঠার সম্ভাবনা এবং উপাসনা-স্থল হতে পারে নাট্য-নিবেদনের ভূমি।’
করোনাভাইরাসের ফলে আমাদের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন এসেছে, তা থেকে একটা শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করতে হবে যে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আমরা মানুষেরা বাঁচতে পারব না। একটু সচেতন হলেই আমরা পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে পারি। প্রকৃতি এবং এ পৃথিবীর সব জীবজন্তু,পশুপাখির সঙ্গে সহাবস্থান করেই কেবল আমরা আগামীর বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ে তুলতে পারব। জয় হোক মানুষের, জয় হোক নাটকের।
লেখক বিশ্ব আইটিআই-এর সাবেক সভাপতি, বর্তমানে সাম্মানিক সভাপতি।