জন্মদিনে সুমনের জন্য ভালোবাসা
১৯৯২ সালে পৃথিবী কোন দিকে হাঁটছে, তা বুঝতে পারছিল না অনেকেই। শোষণ থাকবে না মানুষের জীবনে—এমন বিশ্বাসে দীক্ষা নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা হঠাৎ দেখলেন, তাঁদের অঙ্গীকারে কেউ ঢোকাল ছুরি। কিছুদিন আগেই ভেঙে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পেরেস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্তের হাত ধরে পুঁজিবাদ এসে বসেছে সে দেশের উঠানে। তারপর দখল করে নিয়েছে ভিটেটাও!
সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করছিলাম আমরা কেউ কেউ। দেশজুড়ে ছাপোষা মানুষের হাহাকার আর নব্য ধনিক শ্রেণিদের আস্ফালন দেখতে পাচ্ছিলাম যুগপৎ। দেশ থেকে রাশিয়ার ক্রাসনাদার শহরে ফেরার সময় বন্ধু রিপন (বর্তমানে ড. মনিরুল ইসলাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজির অধ্যাপক) নিয়ে এল ক্যাসেট। তখনো সিডি বলে কিছু ছিল না। ছিল ফিতেওয়ালা ক্যাসেট। টেপ রেকর্ডার বা স্টেরিও সেটে তা বাজিয়ে শোনা হতো।
এই নতুন ক্যাসেটটি বেজে উঠতেই আমাদের বিস্ময়ের ঘোর আর কাটতে চায় না। এত দিন আমাদের সঙ্গী ছিলেন হেমন্ত, মানবেন্দ্র, সন্ধ্যা, আজম খান, লতা, কলিম শরাফী, ফাহমিদা খাতুনেরা। গণসংগীত, আধুনিক, রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলের গানেই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম আমরা। এরই মধ্যে সুমন চট্টোপাধ্যায়! ‘তোমাকে চাই’—বলে আমাদের যেন অবশ করে ফেললেন। ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’, ‘বাশুরিয়া’—এক-একটা গান শুনি আর অবাক হই।
নাহ! এ এক অন্য জগৎ। এই জগতের খোঁজ আগে কখনো এভাবে পাওয়া যায়নি।
রাশিয়ার ক্রাসনাদার শহরের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ নম্বর হোস্টেলে তখন যেন একের পর এক কবিতা রচনা করে চলেছেন সুমন! আমরা খেয়াল করতে থাকি, গান চলে এসেছে একেবারে জীবনযাপনের ধরনের কাছাকাছি। গানের মধ্যে জন্ম নিচ্ছেন আশপাশের নায়কেরা। সেখানে সলিল চৌধুরী আছেন, আছেন অরুণ মিত্র। সেখানে শোনা যায় অখিলবন্ধু ঘোষের গলা! সেখানে একটি ঘুড়ি আর ১২-১৩ বছর বয়সী এক রিকশাচালকের কথা যেন আমাদের গালে সপাটে চাবুক মারে।
এর অনেক পরে একদিন দেখা হয়ে যায় শুভেন্দু মাইতির সঙ্গে। তিনিই শোনান গল্পটা। একদিন শুভেন্দু রাস্তায় এ রকম একটি দৃশ্য দেখেছিলেন। তারপর ছুটে এসেছিলেন সুমনের কাছে। বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন, এ রকম একটা গান চাই।
হ্যাঁ, সে গানটা তৈরি হয়েছিল বটে! শুধু তৈরি হয়ইনি, শুধু কানেই ঢোকেনি, মিশে গেছে সংগীতপিপাসু মানুষের মজ্জায়।
এরপর সুমনের একেকটা গান, একেকটা নতুন পৃথিবীর জন্ম যেন!
কথোপকথন
যেবার ‘জাতিস্মর’ চলচ্চিত্রের ‘এ তুমি কেমন তুমি’র জন্য রূপঙ্কর বাগচি পেলেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সেরা গায়ক ক্যাটাগরিতে পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার পান কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায় এরই মধ্যে কবীর সুমন হয়েছেন।)। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কবীর সুমনকে অভিনন্দন জানানোর জন্য ফোন করেছিলাম। প্রথমে ধরলেনই না। এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে পাঠালাম মেসেজ। ফোন ধরেই বললেন, ‘আমার শরীর ভালো নয়। এক মিনিটের বেশি কথা বলতে পারব না।’
এইরে! ফোনেই একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু এ কী কথা! তাঁর মেজাজ নরম করার জন্য আমি ১৯৯২ সালের রাশিয়ায় তাঁর ক্যাসেট শোনার কথা পাড়ি। তাতে কাজ হয়। কোন গান ভালো লাগে, কোনটা লাগে না—এ ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন। বুঝতে পারি, কাজ হবে।
যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, তা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন। ‘এ তুমি কেমন তুমি’ গানটি রূপঙ্করের আয়ত্তেই আসছিল না। পরে অনেক কষ্ট করে গানটি করাতে পেরেছেন বলে জানালেন। আক্ষেপ করলেন, গানটি এত যন্ত্রপাতি দিয়ে করার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। কিন্তু বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে।
আরও কিছু বিষয়ে জানার ইচ্ছে ছিল। সে পথ পরিষ্কার করার জন্য বললাম, ‘এখন তো খুব একটা গান করছেন না আপনি। আমি কি ভুল জানি?’
খুবই জলদগম্ভীর গলায় কবির সুমন বললেন,‘ ভুল জানেন। তার মানে আপনি আমার এখনকার কাজের খবরই রাখেন না।’
আমি ইতস্তত করার ফাঁকেই তিনি জানিয়ে দিলেন কোথায় গেলে তাঁর গানের খবর পাওয়া যাবে। বলেন, ‘সবাইকেই সব সময় স্টেজে পারফর্ম করে জানান দিতে হবে যে তিনি গান করছেন, এর কোনো মানে নেই। প্রকৃত সমঝদার নিজেই তাঁর প্রিয় শিল্পীকে খুঁজে নেয়।’
পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এরপর নতুন কোনো প্রশ্ন করার সাহস হয়নি আমার।
অন্যভাবে দেখা
বহুকাল বিদেশ বাসের পর দেশে ফিরে যথেষ্ট খ্যাতি পেলেন এবং একসময় রাজনীতিতেও জড়ালেন। কিন্তু সেখানে পেলেন না সুখের খোঁজ। তাই আবার ফিরে এলেন নিজের ডেরায়। এখন মাঝেমধ্যে ফেসবুকে তাঁকে পাওয়া যায়। নানা বিষয়ে কথা বলেন।
আমি সুমনকে খুঁজি তাঁর বইপত্রে। বলেন যেমন, লেখেনও তেমনি। চাঁছাছোলা।
আমি আজ শুধু তাঁর ‘আলখাল্লা’ বইটি নিয়েই কয়েকটি কথা বলব। যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন সেখানে পিট সিগার, রবীন্দ্রনাথ, রবিশঙ্কর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কোহেনের কথা আছে। আরও আছে আলখাল্লা নামের রচনাটিতে সুমনের সব বিড়ম্বনার কথা। বেশ কিছু সাংবাদিক সুমনের পেছনে লেগে কীভাবে তাঁকে হেনস্তা করতে চেয়েছেন, তারই বর্ণনা। একটি কথাই কেবল উল্লেখ করি। সুমনকে বিতর্কিত করার জন্য পত্রিকা সম্পাদকেরাও কম মেহনত করেননি। সুমনের এক স্নেহভাজন সাংবাদিককে পাঠকের চিঠিসমেত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুমনের কাছে। সেই চিঠি দেখে উত্তেজিত সুমন যদি পাল্টা জবাব দেন, তাহলেই তো পত্রিকার পোয়াবারো। একবার সে রকম একটি উত্তর দিয়েছিলেন সুমন। সওয়াল-জবাবের মতো করে ছাপা হয়েছিল তা। এরপর সাংবাদিককে বুঝিয়ে বলেছিলেন সুমন। তিনি বুঝেছিলেন যে এভাবে কিছু করা যায় না। তাতে সাংবাদিকটি পত্রিকা সম্পাদকের কাছে বেশ সাজা পেয়েছিলেন বলে ধারণা করেছিলেন কবির সুমন।
রবিশঙ্কর আর হেমন্তের সঙ্গে
ওই ‘আলখাল্লা’ বইটিতে এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে কথা বললে অনেকেরই ভালো লাগত। এই স্বল্প পরিসরে সে আলোচনা হয় না। তাই অল্প কয়েকটি কথা বলেই এ লেখার ইতি টানা ভালো।
রবিশঙ্করের সঙ্গে আলাপচারিতায় শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যাপারে পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের পার্থক্যটা জানতে চেয়েছিলেন সুমন। রবিশঙ্কর বলেছিলেন, সময়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ভারতে অনেকক্ষণ ধরে মানুষ আলাপ শুনতে চায়। এক ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা কোনো রাগের আলাপের পর গৎ, এরপর আবার একটা রাগ। এভাবে দু-তিনটি রাগ চার-সাড়ে চার ঘণ্টায় বাজানোর পর অনুষ্ঠান শেষ হয়। কিন্তু পশ্চিমে একটা কনসার্ট শেষ করতে হয় আড়াই ঘণ্টার মধ্যে। ওরা তো ভারতের এই দীর্ঘ সময় ধরে রাগের নাড়াচাড়া নিয়ে অভ্যস্ত নয়। মাঝে আবার দিতে হয় ইন্টারভেল বা বিরতি। এই বিরতি দিয়ে কনসার্ট করায় ভারতের সংগীত সমালোচকদের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন রবিশঙ্কর। কিন্তু তখন যদি রবিশঙ্কর এটা মেনে না নিতেন, তাহলে পরবর্তীকালে রাগসংগীতের পাশ্চাত্যে এতটা সমাদর হতো না।
ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো।
কবীর সুমন রবিশঙ্করকে প্রশ্ন করেছিলেন, শিল্পীজীবনে বা সংগীতজীবনে কি কোনো অপূর্ণতা আছে? ব্যর্থতাবোধ?
রবিশঙ্কর এই প্রশ্নের উত্তরে টেনে এনেছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু বাবা আলাউদ্দিন খাঁকে। বলেছিলেন, খাঁ সাহেবের মুখেও এ ধরনের কথা শুনেছেন তিনি। ‘সব শিল্পীরই বুঝি এই ব্যথা থাকে, থাকা উচিত। সব করেও মনে হয় কিছুই করা হয়নি। মানে সব পেয়েও মনে হয় কিছুই পাইনি, সব দিয়েও মনে হয় এখনো দেওয়ার আছে। এসব মিলিয়েই আসে ব্যর্থতা।’ সুমনকে বলেছিলেন রবিশঙ্কর।
হেমন্তকে সুমন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাংলা গানের ভবিষ্যৎ কী?’ হেমন্তের জবাব ছিল, ‘এ উত্তর দেওয়া শক্ত।’ ভবিষ্যতে কী হবে, তার উত্তর দিতে চাননি হেমন্ত। বলেছেন, ‘তবে এটুকু জানি যে রবীন্দ্রসংগীত আমাদের থাকবে, এটা যাবে না। এবং এই যে ভাবছেন অনেকে, ১৯৯০ সালের পর এই রবীন্দ্রসংগীত একেবারে অনেকে যা-তা করে গান করবে, তা হবে না। সেভাবে গান করলে কেউ শুনবে না। যে ধারা রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন, যে সুরের ধারা, সেটা একটু অদল-বদল হয়তো হবে, কিন্তু সেই কাঠামোটা ঠিকই থাকবে।’
২০২০ সালে এসে আমরা দেখছি, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও রবীন্দ্রসংগীত দাঁড়িয়ে আছে নিজেরই কাঠামোর ওপর। এই গানকে ভেঙে, দুমড়েমুচড়ে নতুন কিছু তৈরি করা যায়নি।
সলিল চৌধুরী সম্পর্কে হেমন্তের মূল্যায়ন ছিল এ রকম, ‘অসাধারণ সুরশিল্পী। ওর মধ্যে একটা অরিজিনালিটি আছে। অন্যের সঙ্গে তফাৎ। ওর লেখা বা সুরে আমি তো অনেক গান করিয়েছি। প্রতিটি গান লোকের ভালো লেগেছে। কবেকার সেই “গাঁয়ের বধূ”, “রানার” এখনো লোকে শুনতে চায়।’
অনুকরণ থেকে কি কিছু বেরিয়ে আসে? এ রকম একটি জিজ্ঞাসার উদয় হয়েছিল সুমনের মনে। হেমন্ত বলেছিলেন, তিনি এখন কাউকে শেখাচ্ছেন না। কিন্তু তাঁকে অনুকরণ করছিল অনেকে। কিন্তু অনুকরণে তো শিল্পী জন্মায় না। হেমন্ত নিজে যখন শুরু করেছিলেন, তখন অনুকরণ করতেন পঙ্কজ মল্লিকের। নিজেই বুঝতেন এটা বদলানো দরকার। আস্তে আস্তে উচ্চারণ, স্টাইল নিজেই তৈরি করেছিলেন হেমন্ত। অনুকরণকারীরা হেমন্ত, রফি বা লতার গান পেলে বেশ ভালো গাইছে। কিন্তু নতুন গান দিলে আর গাইতে পারছে না। শিল্পীর নিজের তো সত্তা থাকতে হবে। নইলে দাঁড়াবে না গান।
আবার শিল্পীর ব্যর্থতার প্রসঙ্গ এনেছিলেন সুমন। হেমন্ত বলেছিলেন, তাঁর জীবনে কোনো ব্যর্থতা নেই। কারণ, তিনি যখন যে কাজ ধরেন, তখন আগেই ভেবে নেন যে ব্যর্থ হবেন। সে জন্যই ব্যর্থতা নেই।
সুমনও ব্যর্থ হতে শেখেননি। এখনো তিনি তাঁর নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে গাইছেন গান। আলোকিত করছেন সংগীতপিপাসুদের হৃদয়।