আসল সাজিদ নকল সাজিদ
>সংগীতাঙ্গনের বিভিন্ন তারকার সঙ্গে ভক্ত পরিচয় দিয়ে ছবি তুলতেন ইমন হোসেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ছবিগুলো ব্যবহার করে একসময় শুরু করেন ভয়াবহ প্রতারণা। নিজেকে পরিচয় করান সংগীত পরিচালক সাজিদ সরকার নামে। শিহাব শাহীনের ছুঁয়ে দিলে মন এবং মিজানুর রহমানের বড় ছেলেসহ বেশ কিছু নাটক–সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেছেন সাজিদ সরকার। সাজিদের নামধারী ইমনের প্রতারণার শিকার হন দেশের নবীন গায়ক–গায়িকা, সুরকার, গীতিকার, নির্মাতা এবং অভিনয়শিল্পীরা। আসল ও নকল সাজিদের কাহিনি তুলে ধরছেন মনজুরুল আলম
ভুয়া সাজিদ সরকার মানে ইমন হোসেন জানতেন, আসল সাজিদ সব সময় নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন। এই সুযোগ কাজে লাগান ইমন। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ‘সাজিদ সরকার’ নামে ভুয়া একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন তিনি। নিজেকে সংগীত পরিচালক সাজিদ সরকার প্রমাণ করার জন্য ফেসবুকে বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের বন্ধু হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেন। তারপর আসল সাজিদ সরকারের সব কাজের লিংক পাঠিয়ে তারকাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। কথা বলতে বলতে গড়ে তোলেন বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
ধাপে ধাপে প্রতারণা
ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার পর সবার কাছে নিজেকে একজন মেধাবী সংগীত পরিচালক হিসেবে উপস্থাপন করতেন ইমন হোসেন। বলতেন, বেছে বেছে কাজ করেন বলে তাঁর আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। প্রথম পরিচয়ে প্রতারণার জন্য টার্গেট করা ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৬৭ টাকার মোবাইল রিচার্জ চাইতেন। অল্প পরিমাণের ওই টাকাটা পেলে শুরু হতো ইমনের আরেক চাল। বিকাশের মাধ্যমে টাকা চাইতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতারণার শিকার এক নবীন গায়ক বলেন, ‘সাজিদ সরকারের মতো প্রতিভাবান একজন সংগীত পরিচালকের সান্নিধ্য অবশ্যই লোভনীয়। টাকা দিয়ে ভাবতাম, তাঁর সঙ্গে একটি কাজ করলেই তো সবাই আমাকে চিনবে। সেসব ভেবে মুঠোফোন ও বিকাশে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিলাম।’
ইমন যেভাবে সাজিদ
ইমন হোসেনের প্রতারণার শিকার দুজন গায়ক—একজন গীতিকার ও একজন নবীন অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি আমরা। ইমন সম্পর্কে বলেছেন তাঁকে কাছ থেকে দেখা ঢাকার নিউমার্কেটের কয়েকটি দোকানের কর্মী, উত্তরার দুজন এলাকাবাসী এবং ঢাকার আজিমপুরবাসী ইমনের এক কাছের ছোট ভাই। এ ছাড়া কথা হয়েছে একাধিক নাট্যনির্মাতার সঙ্গে। এমনকি আজিমপুরের নিউ পল্টন এলাকার যে বাসায় ইমন থাকতেন, সে বাসার গৃহকর্মীর সঙ্গেও কথা হয়েছে আমাদের। তাঁদের সবারই এক কথা, ‘ও তো দুই নম্বর।’ তাঁদের সবার কথা শুনে আমরা জেনেছি, ইমন ঢাকায় থাকেন ১৪ বছর ধরে। একটা সময় তিনি পোশাক তৈরির কারখানা এবং দোকানে কাজ করতেন। তিন বছর ধরে গান ও নাটকের জগতে ঢুকে শুরু করেন প্রতারণা। তার আগে নাট্যনির্মাতা হিসেবেও নিজেকে পরিচয় দিতেন। সেই সঙ্গে টাকা নিতেন উঠতি শিল্পীদের কাছ থেকে। ধরা পড়বেন বুঝতে পারলেই বদলে ফেলতেন মুঠোফোন নম্বর ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। আর নাট্যনির্মাতার ভুয়া পরিচয় ধরা পড়ে যাওয়ার পরই নতুন কৌশল খুঁজে নেন ইমন। প্রতারণা শুরু করেন তরুণ সংগীত পরিচালক সাজিদ সরকারের নামে। ইমন হোসেনের আসল নামটি আমরা জেনেছি, আজিমপুরবাসী তাঁর অনুজপ্রতীম হাসানের কাছ থেকে।
আগুনও চিনতে পারেননি
২০১৯ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ফেসবুকে ভুয়া সাজিদ সরকারের সঙ্গে যুক্ত হন তরুণ কণ্ঠশিল্পী মাহবুব মিনেল। তিনিও ইমনকে একাধিকবার টাকা দিয়েছেন। একসঙ্গে ঘুরেছেন বিভিন্ন অখ্যাত রেকর্ডিং স্টুডিওতে। সেসব স্টুডিওতে প্রায়ই ইমনের প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া আরও অনেকে গানের ডেমো ও সুর করানোর জন্য আসতেন। ভুয়া সাজিদের কাজের মান দেখে মিনেলের মনে খটকা লাগে। তবে তারকা ও সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ আছে দেখে ভুয়া সাজিদের ওপর বিশ্বাস রাখেন মিনেল। এ বছরের শুরুর দিকের কথা। মাহবুব মিনেলকে কণ্ঠশিল্পী আগুনের বাসায় নিয়ে যান ইমন হোসেন।
ফেসবুকে ভুয়া সাজিদ সরকার সংগীতশিল্পী আগুনের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়েছিলেন বেশ কদিন ধরে। সরাসরি দেখা হওয়ার পর আর সবার মতো আগুনও ইমনকে আসল সাজিদ ভেবে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর সংগীত পরিচালনার প্রশংসা করেন। প্রথম আলোকে আগুন বলেন, ‘আমি তো ভাবতেই পারিনি, সে প্রতারক! আসল সাজিদই মনে করেছিলাম।’
এ প্রসঙ্গে মাহবুব মিনেলের বক্তব্য, ‘আগুন ভাই ও সাজিদ ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ বিরাট ব্যাপার। তাই আমি গান ও মিউজিক ভিডিও তৈরির জন্য প্রযোজকের ব্যবস্থা করেছিলাম।’
যেভাবে ধরা পড়লেন
মাহবুব মিনেলের গানের জন্য সাজিদ সরকারের সঙ্গে দেখা করতে যান সংগীত প্রযোজক আকরাম খান। এ সময় সঙ্গে করে নিয়ে যান আরেক সংগীত ও নাট্য পরিচালক সৌমিত্র ঘোষকে। ইমন হোসেন তত দিনে আসল সাজিদ সরকারের কিছু গানের ওয়েব লিংক দেন প্রযোজক আকরাম খানকে। কিন্তু দেখা হওয়ার পরই ধাঁধার সমাধান পেয়ে যান আকরাম ও সৌমিত্র। কারণ, সৌমিত্র আসল সাজিদকে ভালো করেই চিনতেন। তাই দেখা হওয়ামাত্র সৌমিত্র বলেন, ‘আপনি তো সাজিদ সরকার নন! আপনি মিথ্যা বলছেন।’ তা শোনার পর আর একমুহূর্ত দেরি না করে বৈঠক থেকে উঠে যান ভুয়া সাজিদ সরকার অর্থাৎ ইমন হোসেন। মাহবুব মিনেলও সেই সময় ইমনের সঙ্গে উঠে যান। এত কিছুর পরও ইমন মিনেলকে বলেন, ‘এদের আমি পাত্তা দিই না। তাই ওরা এসব বলে। দেখবেন, কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দেবে।’ এসব বলে তাঁরা আবার আগুনের বাসায় যান। মাহবুব মিনেল আগুনের একটি গান ফেসবুকে লাইভ প্রচারও করেন। যেখানে ভুয়া সাজিদ সরকারকেও দেখা যায়। সেই রাতেই মাহবুব মিনেলকে ইনবক্সে এক ব্যক্তি একটি লিংক পাঠান।
ভুল ভাঙে পত্রিকার ছবিতে
লিংকটি ছিল প্রথম আলোর একটি খবরের। লিংকে ঢুকে চমকে ওঠেন মাহবুব মিনেল। ওই খবরে থাকা আসল সাজিদের ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। মাহবুব মিনেল বলেন, ‘তিনি প্রতারক জানার পর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিই। খুব দ্রুত বিষয়টি আসল সাজিদ সরকারকে জানাই।’
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক রাশেদ হকও আমাদের জানিয়েছেন ভুয়া সাজিদের ব্যাপারে। রাশেদ বলেন, ‘ভুয়া সাজিদ নিজে থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। পরে আমি তাঁর কাছে দুজন নবীন শিল্পীকে পাঠিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো ওই নবীন শিল্পীদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু পরে বুঝতে পারি, আমি নিজেও ভুল মানুষকে বিশ্বাস করেছি।’
পুরান ঢাকা থেকে দিয়াবাড়ি
ভুয়া সাজিদ সরকার কোথায় থাকেন? বিভিন্নজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্রথমে আমরা যাই পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে। সেখান থেকে খবর নিয়ে চলে যাই আজিমপুরের ইরাকি মাঠ এলাকায়। সেখানে আমরা পাই হাসানকে। ইমনের সঙ্গে তাঁর এখনো কথা হয়। হাসান বলেন, ‘আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। তিনি তখন নিজেকে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। অনেকবার আড্ডার সময় বুঝতে পারি, লোকটা দুই নম্বর। তাঁর আসল নাম ইমন হোসেন। তিনি এখন কামরাঙ্গীরচরে থাকেন। আমাকে বলেছিলেন, তাঁর বাড়ি কুমিল্লায়। পরে জেনেছি, তাঁদের আসল বাড়ি ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়িতে।’
আমাদের সামনেই হাসান বেশ কয়েকবার ইমনকে ফোন করেন। হাসান বলেন, ‘ভাই, আমি তো চরে (কামরাঙ্গীরচর) আছি। আপনি কি আছেন এলাকায়?’ ওপাশ থেকে ইমন বলেন, ‘বাইরে আছি, আবার এসে ফোন দিয়ো।’
উত্তরার দিয়াবাড়িতে ইমন হোসেনের প্রতিবেশী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সে ২০০৫ সালে দিয়াবাড়ির কামারপাড়া থেকে তার মামার মোটরসাইকেল চুরি করে। তারপর থেকেই এলাকাছাড়া। ভুয়া সাজিদ সরকার ওরফে ইমন হোসেনের বাবা থাকেন পাশের এলাকা চন্ডালপুরে। এলাকায় তাঁর নামেও নানান অভিযোগ আছে।’
ইমন হোসেনের বক্তব্য
মুঠোফোনে অনেকবার চেষ্টা করার পর ভুয়া সাজিদ সরকার ওরফে ইমন হোসেনকে পাওয়া গেল। ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ৩৩ মিনিটে ফোন ধরেন তিনি। ৭ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড কথা হলো। বক্তব্যের শুরুতেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ইমন বলেন, ‘আমিই সাজিদ সরকার। দেশে কি এক নামে আরেকজন থাকতে পারে না? আমার নিজের নামেও বেশ কিছু ভুয়া অ্যাকাউন্ট আছে।’
আপনি আরেকজন সাজিদের কাজ কেন নিজের বলে দাবি করেন? এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজের কাজ মানুষের কাছে শেয়ার করি। আমি কেন অন্যের গান নিজের নামে দেব? সব আমার করা। আমি প্রতারণার শিকার, আমি অনেকের উপকার করেছি। এসব নিয়ে কথা বলতে একটি টিভি চ্যানেলে আমি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার বক্তব্য কেটে আমাকে ভুয়া বানানো হয়েছে। আমি চাইলে মামলা করতে পারি। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার আমার আছে।’
ইমন হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার ঠিক দুই ঘণ্টা আগেও আমরা তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ঢুঁ মারি। তখন দেখতে পাই, সংগীতশিল্পী বেলাল খানের সঙ্গে তোলা ছবি শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, ‘কাজের ফাঁকে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইমন বলেন, ‘ভারতের একজন গানটি করাচ্ছে। বাজেট ঠিকঠাকমতো হলেই আমরা শিগগিরই কাজ করব।’ এসব বলেই লাইন কেটে দেন ইমন হোসেন। তাঁর আরও দুটি মুঠোফোন নম্বরে চেষ্টা করেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: ‘আমি আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি’ : সাজিদ সরকার