কমছে প্রেক্ষাগৃহ, কমছে দেশি চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা, প্রযোজকেরাও এ শিল্পে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি আগামী ১২ এপ্রিল থেকে সারা দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলমান এই সংকটের মধ্যে প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র আনন্দ–এ গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছিল ‘সারা বিশ্বের ছবি দেখতে চাই: সব কটা জানালা খুলে দাও’ শীর্ষক নিবন্ধ। সেই লেখার পরিপ্রেক্ষিতেই আজ লিখেছেন বাংলাদেশ প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ
২১ মার্চ প্রথম আলোয় ‘সারা বিশ্বের সব ছবি দেখতে চাই: সব কটা জানালা খুলে দাও’ শিরোনামে শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক মতিউর রহমান একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ভূমিকায় লিখেছেন, ‘ভয়ানক হারে কমছে প্রেক্ষাগৃহ। সিনেমাও নির্মিত হয়েছে কম। প্রযোজকেরা এই শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না।’ এ বাস্তবতা মেনেই মতিউর রহমান কলম ধরেছেন। এতে তিনি দেশীয় সিনেমার অতীত ও বর্তমানের চিত্র স্পষ্ট করেছেন। অথচ জুজুর ভয় দেখিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পকে পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। এতে করে ১৬ কোটি মানুষের দেশে সর্বসাকল্যে ১৭৪টি সিনেমা হল থেমে থেমে চলছে। জনসংখ্যা যখন কম ছিল, তখনো আমাদের দেশে ১ হাজার ৫০০ সিনেমা হল বিনোদনের বড় মাধ্যম হিসেবে দাপট দেখিয়েছে। তখন গড়পড়তায় ছবি নির্মিত হতো অন্তত ১০০ থেকে ১১০টি। তখনো যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মিত হতো। ছবি আমদানি হতো।
সময় বদলেছে, রীতির পরিবর্তন হয়েছে। এসেছে রুচিরও পরিবর্তন। বিশ্বায়নের বিষয়টি চলে এসেছে সামনে। মতিউর রহমান তাঁর নিবন্ধে এ ব্যাপারটি বিচক্ষণভাবে তুলে ধরেছেন।
তিনি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ–পরবর্তী সরকারি নির্দেশে ভারতীয় ছবি বন্ধ হওয়ার পরও লাহোর, করাচি, হলিউড, রুশ, ইতালীয় সিনেমার সঙ্গে ঢাকা বা উর্দু সিনেমার সাফল্যের তুলনা টেনেছেন। সেখানে বিশ্বকাঁপানো সব অভিনেতা–অভিনেত্রীর ভিড়ে ঢাকাই ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবদানকেও গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এতে এটা স্পষ্ট যে আমাদের চলচ্চিত্র কেবল কনটেন্টেই পিছিয়ে নেই শিল্পী–সংকটও প্রকট।
এক জায়গায় তিনি ওই সময় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নির্মাতার সাফল্যের কথাও স্মরণ করেছেন। সেখানে ১৯৭০ সালে নির্মিত জহির রায়হানকে দুইভাবে বেছে নিয়েছেন। প্রথমত, জীবন থেকে নেয়া যে সিনেমাটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ভালো নির্দেশনার দৃষ্টান্ত হিসেবে। ছবিটি স্বাধিকার দাবিতে ব্যাপকভাবে গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছিল। অর্থাৎ সামগ্রিক চেতনার ভাস্বর হয়ে ওঠা জ্বলন্ত উদাহরণ এটি। দ্বিতীয়টি হলো—প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ। অর্থাৎ যে বাঙালিকে বলছি আজ পারবে না বা বিদেশি ছবির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারব না, সেই বাঙালি পরিচালকই প্রথম ১৯৬৪ সালে নির্মাণ করেন রঙিন সঙ্গম, পরের বছর পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি বাহানা, একই বছর বাঙালি পরিচালক মুস্তাফিজ নির্মাণ করলেন রঙিন ও সিনেমাস্কোপ ছবি মালা। এগুলো কিন্তু নির্মিত হয়েছে চ্যালেঞ্জ নিয়ে। যথারীতি ছবিগুলো তুমুল ব্যবসাও করেছে। একই সঙ্গে প্রচুর বিদেশি ছবিও এসেছে। ধারাবাহিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি ছবির অর্থনৈতিক বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে নির্মিত হয়েছে রূপবান, নবাব সিরাজদ্দৌলার মতো মিথ ও ইতিহাসনির্ভর সব ছবি। তখনো কিন্তু দাবি ওঠেনি বিদেশি ছবির প্রজেকশন বন্ধ করার। এই নির্মাতা বা তাঁদের পেছনে অর্থলগ্নিকারীরা ঝুঁকি নিয়েছেন, কারণ তখনই বিশ্বায়নের প্রভাব দেখতে পেয়েছিলেন তাঁরা।
কিন্তু দৃশ্যপট পরিবর্তন হলো স্বাধীনতার পর। দাবি মতে, বিদেশি ছবি বন্ধ হলো, যৌথ প্রযোজনার ছবির নীতিমালার পরিবর্তন হলো। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিবর্তে লেজ গুটিয়ে গুহায় প্রবেশের নীতির চর্চা শুরু তখন থেকেই। ঘটনাপ্রবাহ হচ্ছে, ধীরে ধীরে মানহীন ছবিতে সয়লাব। ফলে দর্শকশূন্যতায় হাহাকার দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো। এর নেপথ্য কারণ উন্নত গল্প, নির্মাণশৈলী, শিল্পমননের অভাব, প্রযুক্তিকে অস্বীকার করা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ভীরুতা। কিন্তু বিশ্বায়নের সঙ্গে দেশকে এগিয়ে যেতে ‘চলচ্চিত্রশিল্প’কে ঘিরে ভাবনাটা বড় করতে হবে। যৌথনীতিমালার সহজীকরণ করে প্রযোজকদের এগিয়ে আসার সাহস জোগাতে হবে, প্রতিবেশী দেশসহ অপরাপর দেশের ছবিগুলো বৈশ্বয়িক শিডিউল অনুসরণ করে প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়াও জরুরি। ভুলে গেলে চলবে না বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ নিয়েছি বলেই প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন অন্যতম শক্তি। বাণিজ্যেও চলছে এ ধারা। সাহিত্যেও শুরু হয়েছে এ ধারা।
কেবল সংকটের আবর্তে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প। উত্তরণে কালোত্তীর্ণ পদক্ষেপের অভাব প্রকট। শিল্পটাকে কাগুজে করে রাখাটাও আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে কখনো কখনো। অবস্থার উত্তরণে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি এখন সময়ের দাবি। এগিয়ে যাওয়ার ভাবনায় পারস্পরিক দোষারূপের রীতি এড়িয়ে লক্ষ্য স্থিরও করতে হবে অবশ্যই ১২ এপ্রিলের আগে। নয়তো খুব শিগগির আমাদের সিনেমাশিল্প কমিউনিটি সেন্টারের বিনোদনে পরিণত হবে।
লেখক: ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ, সভাপতি, বাংলাদেশ প্রদর্শক সমিতি, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মধুমিতা সিনেমা হল।
পাঠক এ প্রসঙ্গে আপনাদের মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন আমাদের। চিঠি পাঠাতে খামের ওপর লিখুন মতামত ও প্রতিক্রিয়া (আনন্দ)।
ঠিকানা: বিভাগীয় সম্পাদক, আনন্দ, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন ২০-২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫ অথবা ই–মেইল করুন এই ঠিকানায়: [email protected]