সাহিত্য থেকে সিনেমা করার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পাঠকের কল্পনার সঙ্গে সিনেমার দৃশ্যায়নের যোগ তৈরি করা। দেবী বাংলাদেশের পাঠকনন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস। মিসির আলির মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বড় পর্দায় দেখা সাধারণ দর্শক, বিশেষ করে হুমায়ূন–ভক্তদের জন্য এক অদ্ভুত অনুভূতির বিষয়। চলচ্চিত্রটি দেখতে গিয়ে আমাকেও তেমন অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
দেবী চলচ্চিত্রটির সঙ্গে উপন্যাসের মিল অনেক। আবার শিল্পীর স্বাধীনতা নিয়ে পরিচালক অনম বিশ্বাস গল্পটি হাজির করেছেন নতুন এক মোড়কে। রচনা করেছেন নিজস্ব চলচ্চিত্র–মুহূর্ত। যেমন উপন্যাসের মিসির আলি, নীলু, বিলু বা রানুরা ফেসবুক–যুগের মানুষ ছিল না। অনম বিশ্বাসের এই চরিত্ররা ফেসবুক–যুগের। মূল উপন্যাসে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা কাটানোর বিজ্ঞাপনের জবাবে চিঠি পাঠিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহজুড়ে অপেক্ষমাণ নীলুর উৎকণ্ঠাটি ফেসবুক–যুগের টাইম-স্পেসে এ চলচ্চিত্রে সহজেই এঁটে যায়। উপন্যাসে মিসির আলি–নীলুর বেশ কয়েকবার দেখা হলেও সিনেমায় তা বেশি নয়। গল্পটির ধারা এক সুতায় থাকলেও এ রকম ছোট ছোট বহু বিষয় সিনেমাটিকে উপন্যাস থেকে খানিকটা আলাদা ঢঙে পরিবেশন করেছে।
সিনেমার গল্পটি খুব সহজে বলতে গেলে এ রকম—সদ্যবিবাহিত স্ত্রী রানু অশরীরী কিছুর অস্ত্বিত্বে প্রায়ই ভয় পায় বলে আনিস তাকে নিয়ে মিসির আলির শরণাপন্ন হয়। রানুর সঙ্গে কথা বলে মিসির আলি পুরো সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেই উত্তরের সন্ধানে নেমে পড়েন। মিসির আলি যুক্তিবাদী মানুষ। অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোর পেছনে শক্ত যুক্তি দাঁড় করান তিনি। সিনেমা যত এগোয়, যুক্তি আর অযুক্তির দ্বন্দ্ব ক্রমেই গল্পটিকে জটিল করে তোলে। এর সমান্তরাল আরেক গল্পের চরিত্র দুই বোন নীলু-বিলু। ফেসবুকে অচেনা এক লোকের সঙ্গে আকর্ষণে বাঁধা পড়ে নীলু। প্রতিবেশী নীলুর সঙ্গে রানুর হৃদ্যতা থেকেই গড়ে ওঠে এ ছবির ক্লাইমেক্স। ছবিটি পরিণতিতে পৌঁছায় দর্শককে যুক্তি–অযুক্তির বাইরে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে।
সবচেয়ে বেশি সাধুবাদ পাবে দেবী ছবিটির চিত্রনাট্য। সুলিখিত চিত্রনাট্য দর্শককে আগাগোড়া টানটান করে ধরে রাখে এবং পাঠকনন্দিত একটি উপন্যাসকে চলচ্চিত্র–বাস্তবতার নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। ছবির যে উপাদানটি দর্শকের কাছে বেশি উপভোগ্য মনে হবে, তা হলো অভিনয়। জয়া আহসান রানু চরিত্রের ভয়, মায়া ও বিস্ময়কে গেঁথেছেন সুনিপুণ শিল্পীর মতো। চলনে–বলনে দৃশ্যের পর দৃশ্যে চরিত্রের ধারাবাহিকতা রেখে দর্শককে আস্তে আস্তে প্রবেশ করিয়েছেন রানুর জগতে। রানুর রহস্যভরা অভিব্যক্তি জয়া আহসান আশ্চর্য সাবলীলতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ছবিতে তার বহু অভিব্যক্তিরই নানা মানে হতে পারে। সূক্ষ্ম চাহনি, কণ্ঠের সুমিত ব্যবহার ও শরীরী ভঙ্গিমায় চঞ্চল চৌধুরী অনবদ্য। অন্য চরিত্রকে বুঝতে চাওয়ার আগ্রহ এবং একই সঙ্গে যুক্তি–বহির্ভূত বিষয় খারিজ করে দেওয়ার তীব্রতা, এই দুয়ের দ্বন্দ্ব তাঁর অভিনয়গুণে মিসির আলি চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। ফেসবুকীয় যুগের আর দশটা মেয়ের মতো শবনম ফারিয়া খুব সপ্রতিভভাবে গল্পের শুরুতে নিজের চরিত্রটি হাজির করেছেন। কিন্তু ক্রমেই বাড়ির বড় মেয়ের আড়ষ্টতা, প্রেমে পড়ার তীব্রতা ও নার্ভাসনেস, বিলুর সঙ্গে সম্পর্ক, রানুর প্রতি মমত্ব—প্রতিটি অনুভূতি যত্ন নিয়ে রূপায়ণ করেছেন তিনি। বিলু চরিত্রে অহনা উপন্যাসের চরিত্রের মতোই উচ্ছল। ইরেশ যাকেরের সাইকোপ্যাথ চরিত্রটি খুব স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ততা। সবশেষে একজনের কথা না বললেই নয়। সেটি অনিমেষ আইচের করা আনিস চরিত্র। জয়া আহসানের নিরীহ ও সহমর্মী স্বামীর চরিত্রে অনিমেষ আইচ ছিলেন দুর্দান্ত।
সবার কাছ থেকে সুঅভিনয় আদায়ের কৃতিত্ব পরিচালক অনম বিশ্বাসও পাবেন। একই সঙ্গে দেবী উপন্যাস থেকে একটি বিশ্বাসযোগ্য চলচ্চিত্র জগৎ নির্মাণের সুস্পষ্ট পরিচালনাগত সংকল্পের জন্যও তাঁকে ধন্যবাদ দিতে হবে। আর ধন্যবাদ পাবে জয়া আহসানের প্রতিষ্ঠান সি–তে সিনেমা এমন একটি বিনোদনময় নির্মল চলচ্চিত্র উপহার দেওয়ার জন্য।
দেবী ছবিটি সাইকো–থ্রিলার ঘরানার। তবে এর বিষয় নারীর ওপর সহিংসতা এবং অন্য নারীর মনোজগতে সে সহিংসতার দুর্বিষহ প্রতিক্রিয়া। হুমায়ূন আহমেদের গল্পে সব যুক্তি পেরিয়ে অতিপ্রাকৃতেরই জয় হয়। এই ছবির পরিণতিও তার থেকে আলাদা নয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে রানু ও নীলুর চরিত্র দুটি আমাদের চারপাশের আরও অনেক মেয়ের গল্প বলতে চেয়েছে। দেবী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নানা শরীরী–অশরীরী ভয়ে আক্রান্ত দুজন নারীর সহমর্মিতার গল্প। রানুর কাছ থেকে যে অতিপ্রাকৃত শক্তি নীলুর মধ্যে স্থানান্তরিত হয় এবং নীলু বিপদ থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে পারে, তা সেই সহমর্মিতারই প্রকাশ। রানুর অতিপ্রাকৃত বিষয়টির ব্যাখ্যা মিসির আলি করেন যুক্তি দিয়ে। রানুর মনোজগতের ঘটনাচক্রে তার আস্থা নেই। কোনো নির্যাতিতা মেয়ের মনোজগতের বেদনা বোঝার পারঙ্গমতা যেমনটা নেই পুরুষশাসিত সমাজের। মিসির আলি, আনিস বা নীলুর বাবা—এরা সবাই এক কাতারের মানুষ। নিপীড়ক পুরুষ–সমাজই এ ছবির খলনায়ক। মন্দির থেকে চুরি হয়ে যাওয়া এ ছবির দেবীমূর্তি রানু-নীলুদের শক্ত মাটিতে দাঁড় করাতে চায়। এই চাওয়াটা কেবল রূপক নয়, ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের এই সময়ে বরং অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
ছবিটি দেখতে দেখতে এমন অজস্র অনুভূতিমালা জন্ম দেওয়ার কৃতিত্ব দেবী ছবির প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের কুশলীদের। চিত্রগ্রহণে কামরুল হাসান খসরু, শিল্প–নির্দেশনায় সামুরাই মারুফ, পোশাক পরিকল্পনায় আনিকা জাহিন, আবহ সংগীতে প্রবুদ্ধ ব্যানার্জী—সবাই যাঁর যাঁর দায়িত্বে সফল। শব্দ প্রকৌশলে অনির্বাণ সেনগুপ্তের সঙ্গে রিপন নাথ ও সাউন্ডবক্সের প্রচেষ্টায় পাওয়া নিখুঁত শব্দবিন্যাস এবং সজল সরকারের সম্পাদনাও সাধুবাদের যোগ্য।
দেবী উপন্যাসটি যাঁরা আগে পড়েছেন, তাঁদের জন্যও এ ছবিটি বহু নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে অপেক্ষা করছে। আর উপন্যাসটি যাঁরা এখনো পড়েননি, দেবী ছবিটি দেখে বাড়ি ফেরার পথে উপন্যাসটি তাঁরা কিনে এনে দ্রুত পড়ে ফেলুন।
চলচ্চিত্র: দেবী
পরিচালনা: অনম বিশ্বাস
কাহিনি: হুমায়ূন আহমেদ
চিত্রনাট্য ও সংলাপ: অনম বিশ্বাস
অভিনয়: জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, অনিমেষ আইচ, শবনম ফারিয়া, ইরেশ যাকের প্রমুখ।
প্রযোজনা: জয়া আহসান
পরিবেশনা: জাজ মাল্টিমিডিয়া
চলচ্চিত্রটি সরকারি অনুদানে নির্মিত
লেখক: চিত্রপরিচালক