মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের মহত্তম অধ্যায়। এর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের বিজয় ও স্বাধীনতা। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও সংবাদচিত্র।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র তৈরি হয় ১৯৭১ সালে কলকাতায়। ওই সময় চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এগুলো ছিল জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, এ স্টেট ইজ বর্ন, আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটার্স ও বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়নস। এসব ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ত্বরান্বিত করা। এসব চিত্রের বিষয় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, শরণার্থীদের দেশত্যাগ, আশ্রয়শিবিরের দুঃখ-কষ্ট-মৃত্যু, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অভিযান এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রূপরেখাকেন্দ্রিক। জহির রায়হান এই চারটি প্রামাণ্যচিত্রের নামকরণ করেছিলেন ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’। এসব চলচ্চিত্র দেখলে চোখ ভিজে ওঠে এখনো।
১৯৭২ সালে শত্রুমুক্ত পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় নতুন উদ্যমে। সেই থেকে ২০১৮ পর্যন্ত অসংখ্য চিত্র তৈরি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু চলচ্চিত্র দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম কাহিনিচিত্র ওরা ১১ জন (১৯৭২) নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ওরা ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলার বিভিন্ন অপারেশন এতে চিত্রিত হয়েছে। এর নেতৃত্বে রয়েছে ছাত্রনেতা খসরু। ছবির নামটি প্রতীকী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টর এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার অনুসরণে ছবির নামকরণ করা হয়েছে। এই চিত্রে নারী নির্যাতন, মায়ের আত্মত্যাগ, কিশোর মুক্তিযোদ্ধার অংশগ্রহণ, কন্যা কর্তৃক রাজাকার পিতা হত্যার দৃশ্য রয়েছে। চাষী নজরুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হলো সংগ্রাম (১৯৭৩)। এই ছবির কাহিনি গড়ে উঠেছে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের ডায়েরি অবলম্বনে। এতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য বাহিনীর বীরত্বগাথা চিত্রিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের আরেক সার্থক চিত্র সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)। কাহিনি গড়ে উঠেছে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধযুদ্ধ এবং এক ধর্ষিত নারীকে একজন অভিনেতা কর্তৃক স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ নিয়ে।
প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরের প্রথম কাহিনিচিত্র ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)। এতে প্রামাণ্য ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটেছে। ভারতীয় মেয়ে অনিতার প্রেমিক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়। সে ঢাকায় এসে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে আরও গভীরভাবে মর্মাহত হয়। মানবিকতাবোধে আচ্ছন্ন হয় তার হৃদয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান এ ছবির সম্পদ।
যুদ্ধোত্তর পরিবেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অবক্ষয় ধরা পড়েছে খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) ও নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল (১৯৭৪) চিত্রে। আবার তোরা মানুষ হ চিত্রে বিধৃত হয়েছে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র ও তরুণদের কার্যকলাপ এবং এক আদর্শবাদী অধ্যক্ষের দৃঢ়তা। অন্যদিকে আলোর মিছিল-এ চিত্রিত হয়েছে অসৎ ব্যবসায়ীর কার্যকলাপ, তরুণ ছাত্র ও আদর্শবাদী ভাইয়ের সততা এবং এক ভাগনির আত্মহত্যা। দুটি চিত্রেই নাটকীয়তার ছাপ থাকলেও রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা।
মুক্তিযুদ্ধের যে চলচ্চিত্রটির চিত্রভাষা মানবিকতা ও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে, সেটি হারুনর রশীদের রঙিন মেঘের অনেক রং (১৯৭৬)। এই চিত্রে রয়েছে যুদ্ধের সময় রুমা নামের একজন ডাক্তারের স্ত্রী ধর্ষণের পর সন্তানসহ কীভাবে কষ্টের শিকার হয় তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা। একই পরিচালকের আরেকটি ছবি আমরা তোমাদের ভুলবো না (১৯৯০) আবর্তিত হয়েছে মতলব নামের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের কাহিনি নিয়ে।
মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ দুটি কাহিনি চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন। একটি একাত্তরের যীশু (১৯৯৩) এবং আরেকটি গেরিলা (২০১১)। দুটো চিত্রই বাস্তবতা ও শিল্পবোধে জারিত।
সাহিত্যিক, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমণি (১৯৯৫) আবর্তিত হয়েছে ঢাকা শহরের রুদ্ধ পরিবেশে একটি পরিবারের আতঙ্ক এবং বদি নামের একজন গেরিলার অপারেশন ও শহীদ হওয়ার ঘটনা নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র আগামী (১৯৮৪) নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। তিনি পরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১) ও অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫) নির্মাণ করেন। তাঁর তিনটি চলচ্চিত্রই মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়গ্রাহী দলিল।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একেবারে আলাদা ধরনের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ মুক্তির গান (১৯৯৫) নামে। এই চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমাণ গানের দলের কার্যক্রম সার্থকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
তানভীর মোকাম্মেলের পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৬) এবং তৌকীর আহমদের জয়যাত্রা (২০০৫) মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি নারীবাদী চলচ্চিত্র হচ্ছে শামীম আখতারের ইতিহাস কন্যা (১৯৯৯)।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিমধ্যেই আরও বেশ কটি আলোচিত ছবি নির্মিত হয়েছে—যেমন বাপজানের বায়োস্কোপ, অপারেশন জ্যাকপট (প্রামাণ্য), লাল সবুজের দীপাবলি (প্রামাণ্য), ১৯৭১ (প্রামাণ্য), প্রত্যাবর্তন (স্বল্পদৈর্ঘ্য) ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো যেমন ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল, তেমনি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণাদায়কও।