২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ঋত্বিকের লক্ষ্মী

সুরমা ঘটক ও ঋত্বিক ঘটক। বিয়ের কিছুদিন পর তোলা ছবি। ছবি: সংগৃহীত
সুরমা ঘটক ও ঋত্বিক ঘটক। বিয়ের কিছুদিন পর তোলা ছবি। ছবি: সংগৃহীত

‘চিত্রনির্মাতা দুই ধরনের—এক দল পরিচালক, আরেক দল স্রষ্টা। আমি স্রষ্টার দলে।’ নিজের সিনেমা সম্পর্কে বলেছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটক। তিনি প্রয়াত হন ১৯৭৬ সালে। তাঁর সহধর্মিণী সুরমা ঘটক। গত সোমবার রাত সোয়া ১২টায় কলকাতার বাঙুর হাসপাতালে জীবনাবসান হয় এই মহীয়সী নারীর। চলচ্চিত্রের গনগনে আগুনের ফুলকি ঋত্বিককে সামলেছেন সুরমা। সুরমা ঘটকের সমস্ত জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেন ট্র্যাজেডির সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চে পারফর্ম করে যেতে হয়েছে তাঁকে।

‘ঋত্বিক দা, ইউনিভার্সিটিতে বার্গম্যানের সিনেমা চালাচ্ছে। যাবেন দেখতে?’ ঋত্বিকের উত্তর, ‘আরে ধুর! বার্গম্যানের পুরোটাই জালিয়াতি, এক শ ভাগ জোচ্চুরি। আন্তোনিওনির স্টাইলটা ধ্রুপদি। যাকগে, যা বোঝো না তা নিয়ে তোমরা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না। শোনো, আরও ৮-১০ বছর বাদে লোকে আমার ছবি নেবে। আমার ছবি পাগলের মতো খুঁজবে। তোমরা দেখে নিয়ো।’ নিজের সম্পর্কে ঋত্বিকের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ হয়েছে। জীবদ্দশায় দর্শকের উপেক্ষার শিকার হওয়া এই চিত্রনির্মাতার ছবি চলচ্চিত্র দুনিয়া এখন পাঠ্য করে নিয়েছে। ঋত্বিকের সব কাজ সংরক্ষণের ভার ছিল সুরমা ঘটকের কাঁধে। অসমাপ্ত ছবির রিল, অপ্রকাশিত লেখার পাণ্ডুলিপি তিনিই তুলে দিয়েছেন ঋত্বিক-ভক্তদের হাতে।

বোম্বেতে বিমল রায়, ঋষিকেশ মুখার্জিদের সঙ্গে কাজ করেছেন ঋত্বিক। চিত্রনাট্য লিখেছেন দিলীপ কুমার অভিনীত মধুমতি, মুসাফির সিনেমার। কিন্তু এই কাজ ভালো লাগছিল না তাঁর। সুরমাকে চিঠি লিখলেন, ‘দশটা-পাঁচটা গিয়ে বসে থাকতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু পয়সার জন্য এখন চেষ্টা করা। দেখো লক্ষ্মী, এ জীবন আমাদের নয়। ...এসব ছেড়ে দেব। এ হবে না।’ সত্যি ছেড়েও দিলেন। বোম্বে ছেড়ে এলেন কলকাতায়। নিজের মনের মতো ছবি বানাবেন বলে। ইনিই ঋত্বিক ঘটক। আর একবার ওই মুলুকে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী নিজে তাঁকে পুনেতে এফটিআইআইতে ভাইস প্রিন্সিপাল করলেন যখন। আবার ঋত্বিককে পদ্মশ্রী দিলেন এই ইন্দিরা গান্ধীই। ঋত্বিকের কাজের গুণমুগ্ধ ছিলেন ইন্দিরা।

এই ঋত্বিক একবারই প্রেমে পড়েছিলেন। আর সেই পদ্মের মতো প্রেমটি নিয়ে এসেছিলেন যিনি, তিনিই সুরমা ঘটক। ঋত্বিক ডাকতেন তাঁকে ‘লক্ষ্মী’ বলে।

শিলং পাহাড়ের মেয়ে সুরমা। বাংলা ভাগ হয়ে দুই টুকরো হওয়ায় ঢাকার সন্তান ঋত্বিক তখন কলকাতায়। ঋত্বিকের বর্ণনায়, কাগজের বাবুরা তাদের নাম দিয়েছিল উদ্বাস্তু-শরণার্থী। ঋত্বিকের জীবনে শরণার্থী কথাটা শ্লেষ হয়ে কানে বাজত।

সুরমা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ঋত্বিকও তাই। দুজনেই কেন্দ্রীয় সদস্য পদও পেয়েছিলেন। পার্টির সাংস্কৃতিক সংঘ গণনাট্য (আইপিটিএ) করতে গিয়ে পরিচয় দুজনের। উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে নিজের লেখা নাটক দলিল বোম্বেতে মঞ্চস্থ করতে গিয়েছিলেন ঋত্বিক। সেখানে সুরমা ভিড়ের একটি দৃশ্যে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করে দিয়েছিলেন। তার জন্য রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে এলেন। সেই পরিচয়ের শুরু। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল কলকাতায় ফিরে।

গণনাট্য সংঘে ঋত্বিক সুরমাদের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। লেনিন, মার্ক্স, প্লেখানভ পড়াতেন মন্ত্রোচ্চারণকারী ঋত্বিকের মতো ভঙ্গিতে। সুরমা সে মন্ত্রে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। তিনি যে সাধারণ নারী নন। এর আগে কমিউনিস্ট পার্টির জন্য জেল খেটেছেন ১৮ মাস। সেসব লিখে গেছেন শিলং জেলের ডায়েরিতে। বিসর্জন নাটকের মহড়া করাচ্ছিলেন ঋত্বিক। সুরমা করছিলেন ‘অপর্ণা’র রোল। দুটি চোখ এক হলো। দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গেলেন তখনই।

সুরমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া সাধনা রায়চৌধুরী ঋত্বিককে চিনতেন। পই পই করে বললেন, ‘এর সঙ্গে মিশিশ না। বরবাদ হয়ে যাবি। ও ট্রটস্কির তত্ত্ব ছড়াচ্ছে। এই জন্য পার্টি বহিষ্কার করে দিচ্ছে ওকে।’ কে শোনে কার কথা। পার্টি ছেড়ে দিয়ে দুজনে গড়লেন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেললেন দুজনে। ঋত্বিকের মা বললেন, এই মেয়ে সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। ঋত্বিক এক চিঠিতে সুরমাকে লিখেছিলেন, ‘আমার বাড়ির লোকে বলছে, আমাকে কোনো মেয়ের ভালো লাগে কী করে? আমার পা নোংরা থাকে, সস্তা বিড়ি খাই, ধুতি হাঁটু অব্দি উঠে থাকে। আমি নাকি তোমার মোটেই উপযুক্ত নই, মিছিমিছি তোমাকে ডোবাচ্ছি। “লক্ষ্মী” মহিলাটি জলে পড়লেন!’

দারুণ সোনার সংসার হয়েছিল ঋত্বিক-সুরমার। কিন্তু একের পর এক ছবি ফ্লপ করতে থাকে ঋত্বিকের। হতাশ হয়ে পড়েন ঋত্বিক। পয়সা-কড়িও নেই বললেই চলে। সন্তান তিনটি—ছেলে ঋতবান, মেয়ে সংহিতা ও শুচিস্মিতা। এদিকে ঋত্বিক অ্যালকোহলিক হয়ে পড়ছেন দিনে দিনে। বাড়িতে মদের আড্ডা। ঋত্বিক একরোখা—পুরো ইন্ডাস্ট্রি তা জানে। রাজেশ খান্নার মুখের ওপর স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। নিজে জলে পড়েছেন সে নয় মানা গেল, মা হয়ে বাচ্চাদের জীবন অনিশ্চয়তায় ফেলেন কী করে সুরমা? ঋত্বিককে একা ছেড়ে দেবেন, সিদ্ধান্ত নিলেন। শিলংয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলেন সুরমা। এই সেপারেশনেও দুজন দুজনকে চিঠি লিখেছেন মাঝেমধ্যেই।

ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে সুরমার রেফারেন্স এসেছে বারবার। মেঘে ঢাকা তারায় নীতাকে দেখানো হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন জন্মেছেন। আসলে সুরমা জন্মেছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। কোমল গান্ধার-এ কেন্দ্রীয় চরিত্র অনসূয়ার জীবনের সংকটগুলো ছিল আসলে সুরমার সংকট থেকে অনুপ্রাণিত। আর যুক্তি তক্কো গপ্পো তো আত্মজৈবনিক ছবিই। এটিতে সুরমার ছায়া ছিল প্রকট। ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি’ গানটি ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন ঋত্বিক। এই গানটি প্রেমের দিনগুলোতে সুরমাকে গুনগুনিয়ে শুনিয়েছেন যে কতবার! আর এর চিত্রায়ণও করেছিলেন শিলংয়েই।

ঋত্বিকের মৃত্যুসংবাদ সুরমা পান শিলংয়ে বসে। মৃণাল সেন সে খবর দেন। তার পর ৪২ বছর ঋত্বিকের স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ঋত্বিককে স্মৃতিতে ধরে রাখতে লিখেছেন ঋত্বিকপদ্মা থেকে তিতাস বই দুটি। ২০০৯ সালে মারা যায় শুচিস্মিতা। সংহিতাও মারা যায় বছর খানেক আগে। ছেলে ঋতবানও মানসিক রোগে আক্রান্ত দীর্ঘদিন। সত্যি যেন ট্র্যাজেডির নায়িকা রয়ে গেলেন সমস্ত জীবন।