আপনি কি উইল স্মিথের থাপ্পড় মারার পক্ষে?
অন্তত আজ সারা দুনিয়ার মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। একদল উইল স্মিথের পক্ষে, আরেক দল বিপক্ষে। সঙ্গে থাকা স্ত্রী বা বান্ধবীকে অপমান করায় নায়কের হাতে ভিলেনের বেধড়ক মার খাওয়া এত দিন সিনেমায় দেখা গেছে। এবার দেখা গেল বাস্তবে, কোটি কোটি মানুষ ঘরে বসে সরাসরি এর সম্প্রচার দেখেছেন। ৯৪তম অস্কারের আসর ইতিহাসে স্থান করে নিল একটি ঘটনার কারণেই। এর আগে অস্কার অনুষ্ঠানে মানুষ নগ্ন দৌড় দেখেছেন কিন্তু এক তারকার হাতে অন্য তারকার চড় খাওয়ার দৃশ্য বিরল।
মঞ্চে তখন ছিলেন মার্কিন কমেডিয়ান ক্রিস রক। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন পুরস্কার দিতে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে উইল স্মিথের স্ত্রী জাডা পিংকেট স্মিথকে নিয়ে ঠাট্টা করেন ক্রিস। সবাই কমবেশি হেসে দিলেও গম্ভীর হয়ে যান জাডা। এরপরই ঘটনাটি ঘটে সবার চোখের সামনে। মঞ্চে এসে ক্রিস রককে সপাটে চড় কষান উইল স্মিথ। পরে অবশ্য মঞ্চে উঠে ক্ষমা চান স্মিথ। যদিও সরাসরি তিনি ক্রিস রকের নাম উচ্চরণ করে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেননি। তবে সেই ক্ষমা চাওয়ার উপলক্ষটাও ছিল স্মিথের জন্য বড় ঘটনা। তিনি সেরা অভিনেতার অস্কার নিতে তখন আবারও মঞ্চে এসেছিলেন। ‘কিং রিচার্ড’ ছবিতে রিচার্ড উইলিয়ামস চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ৯৪তম অস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছেন উইল স্মিথ।
তবে এত বছর পর উইল স্মিথের অস্কার পাওয়া নয়, বরং চড় মারাই হচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা, যার চর্চা চলবে বছর বছর ধরে। ঘটনার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমগুলোয় নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। পত্রিকায় অনেকেই এরই মধ্যে লিখছেন, অস্কার কর্তৃপক্ষকেও বক্তব্য দিতে হচ্ছে।
এমনিতেই বিশ্বজুড়ে কমেডিয়ানদের দুর্দিন। রাজনৈতিক কৌতুক তো অনেক দেশেই ধরতে গেলে নিষিদ্ধ। অনেক রাষ্ট্রই রাজনৈতিক কৌতুককে আইনি বিধিনিষেধের মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। কার্টুনিস্টরা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ধরনের আইনের কারণে তটস্থ। এক কমেডিয়ান তো দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে আছেন বেশ বিপদে, তাঁকে এখন যুদ্ধ সামলাতে হচ্ছে। আর আজ আরেক কমেডিয়ান খেলেন প্রকাশ্যে চড়। এতে মনে হচ্ছে কমেডিয়ানদের দুর্দিন আরও বাড়ল। ঠাট্টা-রসিকতা পছন্দ না হলে সবাই যদি চড় মারা শুরু করেন, তাহলে তো বিপদ।
সভ্য সমাজে কেউই শারীরিক আক্রমণকে সমর্থন করবেন না। আবার অপ্রস্তুত অবস্থায় শারীরিক আক্রমণ তো আরও নিন্দার যোগ্য। এভাবে চড় মারার নিন্দায় মেতে উঠেছেন বহুসংখ্যক মানুষ, তাঁদের মধ্যে বড় বড় তারকাও আছেন। যেমন রিচার্ড মার্কস টুইট করে লিখেছেন, ‘চুল নিয়ে কৌতুক করায় চড় মারা? চুল নিয়ে কৌতুক!’ আরেক টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘আমি অস্কারের সেই বিজয়ীকে পছন্দ করব, যিনি কৌতুক বলার জন্য একজন কমেডিয়ানকে চড় মারেন না।’
এমি ও গ্র্যামি পুরস্কারপ্রাপ্ত কমেডিয়ান ও বেস্টসেলার লেখক ক্যাথি গ্রিফিন টুইটারে লিখেছেন, ‘মঞ্চে উঠে একজন কমেডিয়ানকে চড় মারার ঘটনা খুবই খারাপ এক উদাহরণ। এখন আমি চিন্তিত এই ভেবে, কোনো কমেডি ক্লাব বা থিয়েটার মঞ্চে কে হবেন পরবর্তী উইল স্মিথ।’
অভিনেতা জর্জ হান লিখেছেন, ‘এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে শারীরিক আঘাতের জন্য কি স্মিথের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে? মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু শারীরিক আঘাত।’ অভিনেত্রী সোফিয়া বুশ লিখেছেন, ‘সহিংসতা ঠিক নয়, আঘাত করা কখনোই কোনো উত্তর হতে পারে না।’
আবার উইল স্মিথের পক্ষেও কথা বলার লোক কম নেই। উইল স্মিথের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘পারসুট অব হ্যাপিনেস’–এর সেই ছোট ছেলের কথা মনে আছে? বাস্তবের বাবা ও ছেলেই ছিলেন সিনেমার বাবা ও ছেলে। সেই জেডেন বাবার পক্ষে টুইট করে লিখেছেন, ‘এবং এভাবেই আমরা যা করার তা করি।’
উইল স্মিথের স্ত্রী অ্যালোপেশিয়া নামে এক রোগে আক্রান্ত। এই রোগ হলে মাথার চুল পড়ে যায়। এ নিয়েই রসিকতা করেছিলেন ক্রিস রক। জাডা পিংকেট স্মিথের দিকে তাকিয়ে ক্রিস বলেন, ‘জাডা, “জিআই জেন টু”-এর জন্য তর সইছে না।’ ‘জিআই জেন’ ১৯৯৭ সালের ছবি, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনয়শিল্পী ডেমি মুরের ছিল ন্যাড়া মাথার জর্ডান ও’নিলের চরিত্র।
স্মিথের পক্ষে কলম ধরেছিলেন মার্কিন রাজনীতিবিদ ও ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি আয়েনা প্রেসলি। তিনি লিখেছেন, ‘অ্যালোপেশিয়া জাতি উঠে দাঁড়াও। ধন্যবাদ উইল স্মিথ।’ এরপর তিনি অ্যালোপেশিয়া নিয়ে মানুষের অজ্ঞতা–অপমান সহ্য করার কথা উল্লেখ করে সব স্বামীকে এভাবে প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান। পরে অবশ্য টুইটটি মুছে ফেলেছেন প্রেসলি।
একই রোগে আক্রান্ত ক্যাথি হাল নামের একজন অস্ট্রেলিয়ার দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে একটি কলাম লিখেছেন। এর শিরোনাম হচ্ছে, ‘আমি জাডার পক্ষে: ভুক্তভোগীর জন্য অ্যালোপেশিয়া কোনো কৌতুক নয়’।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঘটনার জন্য কোনো মামলা হবে, নেওয়া হবে আইনি পদক্ষেপ? দ্য গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ বিভাগ (এলএপিডি) ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত। পুরস্কার মঞ্চে একজন অন্যজনকে চড় মেরেছেন। তবে তাঁদের একজন পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সুতরাং পরে যদি তিনি অভিযোগ জানান, তাহলে পুলিশ পূর্ণ তদন্ত করবে।
পুলিশি তদন্ত হবে কি না, ভবিষ্যৎ বলে দেবে। তবে এ ঘটনার রেশ, তর্কবিতর্ক চলতেই থাকবে। কারও অসুস্থতা, গায়ের রং, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া চেহারা বা কোনো শারীরিক খুঁত নিয়ে আসলেই রসিকতা করা যায় কি না, এ নিয়ে আলোচনা যেমন চলবে, তেমনি চলবে শারীরিক আঘাত করার বিষয়টি নিয়েও কথাবার্তা।
তবে পুরো ঘটনা ক্রিস রক যেভাবে সামলেছেন, তার প্রশংসা করছেন সবাই। শুরুতে অবশ্য ক্রিসের রসিকতায় হাসতে দেখা গিয়েছিল দর্শকসারিতে বসা উইল স্মিথকে। তবে বিরক্ত হন জাডা। এরপর উইল স্মিথ আসন ছেড়ে উঠে মঞ্চে গিয়ে থাপ্পড় মারেন ক্রিসের গালে। থাপ্পড় খেয়ে হতভম্ব ক্রিস দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, ‘টেলিভিশনের ইতিহাসে এটা একটা স্মরণীয় রাত হয়ে থাকবে।’ এরপরও আসনে ফিরে চিৎকার করে স্মিথ তাঁর উদ্দেশে বলেন, ‘তোমার নোংরা মুখে আমার স্ত্রীর নাম নেবে না।’ এ সময় অমুদ্রণযোগ্য একটি অক্ষরও ব্যবহার করেন স্মিথ।
শুরুতে অনেকেই ঘটনাটি সাজানো বলে মনে করলেও দ্রুত সবাই বুঝে ফেলেন, এটা পূর্বপরিকল্পিত নয়, বরং একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এর আগে ১৯৭৪ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে পুরুষ ফটোগ্রাফার ও শিল্পী রবার্ট ওপেল সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অস্কার মঞ্চে উঠেছিলেন। উপস্থাপক ডেভিড নিভেন খুব ভালোভাবে ঘটনাটি সামাল দিয়েছিলেন। তখনো অনেকে মনে করেছিলেন, ঘটনাটি সাজানো।
নগ্ন দৌড়, রাজনৈতিক বক্তব্য, প্রত্যাখ্যানসহ অস্কার অনুষ্ঠান নিয়ে এমনিতেই বিতর্ক কম নেই। কিন্তু সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেল আজ চড় মারার ঘটনাটি।