আগ্রহ বাড়ছে তরুণ নির্মাতাদের

সহপ্রযোজনার বাজারে অংশগ্রহণ করেছে টেলিভিশন ও শুনতে কি পাও!
সহপ্রযোজনার বাজারে অংশগ্রহণ করেছে টেলিভিশন ও শুনতে কি পাও!

সহপ্রযোজনায় (কো-প্রডাকশন) সিনেমা তৈরিতে আগ্রহ তরুণ নির্মাতাদের। এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে। নির্মাতারা অংশগ্রহণ করছেন চলচ্চিত্র বাজারগুলোতে, পাচ্ছেন তহবিলও। তাঁদের বক্তব্য, শুধু অর্থ পাওয়াই আগ্রহের কেন্দ্র নয়। সেখানে গেলে সিনেমা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিবেশনার মাধ্যমে সিনেমা বিতরণেরও সুযোগ পাওয়া যায়।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি উদাহরণ পাওয়া যায়। কামার আহমাদ সাইমনের ‘শুনতে কি পাও!’ যুক্তরাজ্যের জার্নিম্যান ফিল্মস পরিবেশনা করছে। রুবাইত হোসেনের মেড ইন বাংলাদেশ ছবিটির পরিবেশক ফ্রান্সের পিরামিড ফিল্মস। চলচ্চিত্রটির অর্থায়ন হয়েছে সহপ্রযোজনার বাজার থেকে। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের লাইভ ফ্রম ঢাকা কিনেছে প্যারিসের বিপণন সংস্থা স্ট্রে ডগ।

সহপ্রযোজনার বাজার (কো-প্রডাকশন মার্কেট) কী?
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের ওয়েবসাইটে সহপ্রযোজনার বাজার নিয়ে বলছে, এটি চলচ্চিত্রশিল্পে অভিজ্ঞ নানা দেশের প্রায় ৬০০ প্রযোজক ও টাকা লগ্নিকারীদের একটি নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম। সেখানে সহপ্রযোজক ও পরিচালক উভয়েই চলচ্চিত্র নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করার সুযোগ পান। পছন্দসই প্রকল্প সামনে এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এই প্ল্যাটফর্ম প্রতিবছর ৩৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, আটটি সিরিজ, চলচ্চিত্রের জন্য ১২টি উপন্যাস ও পাঁচটি ব্যতিক্রমী দুর্দান্ত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে উপস্থাপন করে। বার্লিন্যালের মতো আরও নানা চলচ্চিত্র বাজার আছে বিশ্বজুড়ে। যেমন, ইউরোপিয়ান ফিল্ম মার্কেট, প্রডিউসারস নেটওয়ার্ক, মার্শ দু ফিল্ম, এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেট, আইডিএফএ ডক ল্যাব ইত্যাদি।
লা ফেব্রিক দ্যু ফিল্মে অংশগ্রহণ করা ‘স্যান্ড সিটি’ প্রকল্পের নির্মাতা মেহেদী হাসান বলেন, ‘বিদেশি ফান্ড, সহপ্রযোজনা ইদানীং বেশি শোনা গেলেও এটা নতুন কিছু নয়। বিশ্বজুড়ে সহপ্রযোজনায় অনেক সিনেমা হয়েছে, হচ্ছে। সম্প্রতি তুর্কি চলচ্চিত্রকার নুরি বিলগে জিলানের ওয়াইল্ড পিয়ার ট্রি নির্মিত হয়েছে সাতটি দেশের অর্থায়নে। প্রতিষ্ঠিত ও নতুন উভয় নির্মাতারাই হাজির হচ্ছেন এখানে।’

কেন তরুণেরা ঝুঁকছেন চলচ্চিত্র বাজারগুলোতে
চলচ্চিত্রের বাজারগুলোতে তরুণদের আগ্রহের অন্যতম কারণ বিশ্বজুড়ে যোগাযোগ তৈরি করা। আর্থিক সহযোগিতা তো আছেই। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেট ও ফিল্ম বাজার ইন্ডিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ‘পিঁপড়া বিদ্যা’ও এই মার্কেটে উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। ডুব দুবাই ফিল্ম মার্কেট ও ফিল্ম বাজার ইন্ডিয়াতে পুরস্কার জিতে নেয়। নো ল্যান্ড’স ম্যান ফিল্ম বাজার ইন্ডিয়ার সেরা প্রকল্প জেতে ও বুসানের এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেটে অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি বলেন, ‘সহপ্রযোজনার বাজারে নির্বাচিত হওয়ার সবচেয়ে বড় দিক তো সবাই জানে, ওখানে প্রযোজক পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু যদি না-ও পাওয়া যায়, তবু এটার একটা লাভ আছে। সেটা হচ্ছে স্ক্রিপ্ট পিচিং। এই যে নানা সংস্কৃতির মানুষের কাছে গল্পটা পিচ (উপস্থাপন) করা, তাদের প্রতিক্রিয়া অবলোকন করা—এর মধ্য দিয়ে জানা যায়, স্ক্রিপ্টের শক্তি কোথায়, দুর্বলতা কোথায় বা কোন নতুন দিকে পাণ্ডুলিপিটাকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি সারা দুনিয়ার ছেলেমেয়েদের চিন্তা জানার সুযোগ তো থাকছেই। ফলে এসব এক্সপোজার যত পাওয়া যাবে, ততই ভালো।’
কামার আহমাদ সাইমন বিদেশি প্রযোজকদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করছেন। কামারের শুনতে কি পাও! প্যারিসে গ্রাঁপ্রি জয়ের সুবাদে প্রথম থেকেই একাধিক আন্তর্জাতিক পরিবেশকদের সঙ্গে পায়। প্রকল্পটি ইডফার ইয়ান ফ্রাইম্যান ফান্ড-স্ক্রিপ্ট ও প্রোডাকশন, ভিশন সুদ ইস্ট-পোস্ট প্রডাকশন, মুভিজ দ্যাট ম্যাটার, ডকেজ কলকাতা বেস্ট পিচ অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। এই প্রকল্পের জন্য কামার আমন্ত্রিত হয়েছিলেন জার্মানির বার্লিন্যালে এডিটিং ল্যাব ও নেদারল্যান্ডসের ইডফা একাডেমিতে। তাঁর একটি সুতার জবানবন্দী ও নতুন ছবি নীল মুকুট যৌথ প্রযোজনা করে এশিয়ার চারটি টেলিভিশন চ্যানেল। লোকার্নোর ওপেন ডোরসে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও আর্তে ইন্টারন্যাশনাল প্রিক্স বিজয়ী জলত্রয়ীর দ্বিতীয় ছবি অন্যদিন যৌথ প্রযোজনা করছে ফ্রান্সের ডিডব্লিউ ফিল্মস ও নরওয়ের ব্যারেন্টস ফিল্মস। নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন বলেন, ‘পোস্ট ৭১ প্রজন্মে স্বাধীনধারার সিনেমা এখন পুরোটাই প্রায় পরাধীন। সেই হিসাবে আন্তর্জাতিক যৌথ প্রযোজনা আমাদের একটি নয়, দুটি ক্রিটিক্যাল সুযোগ এনে দিয়েছে। এক. কতিপয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী না থেকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার। দুই. নিম্নমানের পাতি প্রযোজনার বাইরে শিল্পমাধ্যম হিসেবে সিনেমার ল্যাঙ্গুয়েজ বা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ভাষার সঙ্গে নিজেদের অ্যাপ্রোচ এক্সপ্লোর করার।’
এ ছাড়া এ বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ভ্যারাইটি ম্যাগাজিনের সেরা দশ প্রযোজকের তালিকায় থাকা জার্মানির ওয়াইডাম্যান ব্রস যৌথ প্রযোজনা করছে কামারের ছবি শিকলবাহা। প্রযোজক সারা আফরীন বলেন, ‘লোকার্নোর পর অন্যদিন-এর যোগাযোগগুলা হয়েছে কানের লা এতেলিয়ারে বিশেষ আমন্ত্রণের সূত্রে। আর ওয়াইডাম্যান ব্রসের সাথে আমার যোগাযোগ ইউরোপিয়ান প্রডিউসার্স ওয়ার্কশপ থেকে, সেখানে তিনটি দেশে নয় মাসের ডিপ্লোমায় আমার স্ক্রিপ্ট ছিল শিকলবাহা। বার্লিনের ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড জয়ের সুবাদে আমাদের সাথে যৌথ প্রযোজনায় আসে ওয়াইডাম্যান ব্রস।’

বৈশ্বিক যোগাযোগও বটে
নির্মাতা ও প্রযোজক আরিফুর রহমান গুপি বাঘা প্রোডাকশনের ব্যানারে কাজ করছেন। তাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্প্রতি প্যারাডাইস সিনেমাটি সিয়াটল চলচ্চিত্র উৎসবের ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস বিভাগে নির্বাচিত হয়। বার্লিন্যালেও অংশগ্রহণ করে একটি প্রকল্প।
আরিফুর রহমান বলেন, ‘বড় কথা হলো বিশ্বজুড়ে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। এই বাজারগুলোতে গেলে পরবর্তীকালে প্রযোজকেরা ওই নির্মাতার ওপর নজর রাখেন। অর্থায়নের পাশাপাশি তাঁরা নির্মাতাকে ডেভেলপও করেন। কারণ, তারাও ভালো সিনেমার সঙ্গে থাকতে চান।’
শুধু তাই নয়, এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে দেশি চলচ্চিত্রের বাইরেও বিদেশি সিনেমা প্রযোজনা করা হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে একা ও ওয়েটিং ফর ফ্লাড নামে দুটি ছবি প্রযোজনার কথা চলছে।

দেশেই সহপ্রযোজনার প্ল্যাটফর্ম
খোদ দেশেই আছে ফিল্ম বাজার। ২০১৭ সাল থেকে প্রামাণ্যচিত্রের জন্য ‘ঢাকা ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম নেটওয়ার্ক’ আয়োজন করেছে ‘ঢাকা ডক ল্যাব’। এখানে নির্মাতাদের প্রামাণ্যচিত্র প্রকল্প উপস্থাপিত হয় আন্তর্জাতিক প্রযোজকদের সামনে। এই আয়োজন থেকে দুটি প্রকল্প জাপানের এনএইচকে চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার কথা চূড়ান্ত হয়েছে। ঢাকা ডক ল্যাবের পরিচালক তারেক আহমেদ জানান, আগামী ২৬ থেকে ৩১ আগস্ট বসবে তৃতীয় আসর।