করোনার প্রভাব
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে
■ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৬টি। শিক্ষার্থী প্রায় ৪ লাখ।
■ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার।
করোনাকালে বড় সংকটে পড়েছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষার্থী ভর্তি কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় কমেছে। এ কারণে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জনবল কমাচ্ছে। কেউ কেউ শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কাটছাঁট করছে।
গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া ‘সামার সেমিস্টারে’ আশা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ১৫ শিক্ষার্থী। অথচ গত বছর একই সেমিস্টারে আইন বিভাগের ৫০টি আসনের প্রায় সবগুলো পূরণ হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে একজন শিক্ষার্থীকে প্রতি সেমিস্টারে (চার মাসের) ১৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা টিউশন ফি দিতে হয়। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের মূল উৎস। আশা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সংকটে পড়ে গত মাস থেকে বেশ কিছুসংখ্যক কর্মীকে বিনা বেতনে সাময়িক ছুটিতে পাঠিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ করে বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়া ও চাকরির অনিশ্চয়তায় তিনি মারাত্মক দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডালেম চন্দ্র বর্মণ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের সাময়িক কর্মবিরতি (ছুটি) দেওয়া হয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির তথ্য অনুযায়ী দেশে ১০৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর কয়েকটি কার্যক্রম এখনো শুরু করেনি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেনের হিসাবে, গত বছরের সামার সেমিস্টারের তুলনায় এবার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। কয়েকটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকি সবগুলোতেই এবার শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে। তিনি জানান, সংকট মোকাবিলায় তাঁরা গত মাসে সরকারের কাছে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ চেয়েছেন। তবে এখনো পাননি।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধের মেয়াদ আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। শুরুর দিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধই ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত মে মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস, মূল্যায়ন, ভর্তিসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয় সরকার। আর জুলাই থেকে শুরু হয় সামার সেমিস্টারের ক্লাস।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এবার সামার সেমিস্টারে ভর্তি হয়েছেন ১৮২ শিক্ষার্থী। গতবার একই সেমিস্টারে সংখ্যাটি ছিল ৩৭৫। এই বিশ্ববিদ্যালয় গত এপ্রিল ও মে মাসে অর্ধেক বেতন দিয়েছে এবং জুন মাস থেকে ৮০ শতাংশ বেতন দেওয়া হচ্ছে।
ইউজিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও সংবেদনশীল ও মানবিক হতে হবে।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, করোনা শুরুর আগপর্যন্ত মার্চ মাসে ভর্তি হন ১৩০ থেকে ১৩৫ জন শিক্ষার্থী। গত জুন মাসে ভর্তি হয়েছেন ৭০ জন। অন্যান্য বছর প্রতি মাসে বিভিন্ন কোর্সে ১৫০ থেকে ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হতেন।
‘ব্যয় সংকোচনের’ অংশ হিসেবে ১০৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্প্রতি ছাঁটাই করেছে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। চাকরি হারানো এক নারী কর্মকর্তা বলেন, মধ্যবয়সে হঠাৎ চাকরি হারিয়ে খুবই সংকটে পড়েছেন তিনি।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুল মতিন জানান, যাঁদের ছাঁটাই করা হয়েছে, তাঁদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর আগে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ধানমন্ডির ক্যাম্পাস গুটিয়ে শুধু সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে কারণে আগের মতো এত লোকের দরকার নেই।
শিক্ষকেরা বলছেন, করোনার ধাক্কায় অনেক পরিবারের আয় কমে গেছে। ফলে উচ্চ ব্যয়ে সন্তানদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সক্ষমতা হারিয়েছে অনেক পরিবার।
তবে সংকটের মধ্যেও নর্থ সাউথ, আইইউবি, ব্র্যাক, ইস্ট ওয়েস্ট, ইউনাইটেডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি পরিস্থিতি ভালো। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে সামার সেমিস্টারে এবার ভর্তি হয়েছেন ৪৭৭ জন। গত বছর একই সেমিস্টারে ভর্তি হন ৪০৩ জন।
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তাদের উচিত অবকাঠামোগত খরচসহ অন্যান্য খরচ কমিয়ে শিক্ষক–কর্মকর্তা–কর্মচারী সবাইকে নিয়ে টিকে থাকার ব্যবস্থা করা। অন্যান্য খাতের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও সরকার আপত্কালীন আর্থিক সহায়তা দিতে পারে।