কোচিং ও সহায়ক বইমুক্ত হচ্ছে না শিক্ষাব্যবস্থা
জাতীয় শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং কোচিং, প্রাইভেট ও নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই বন্ধ করার জন্য ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা আইন তৈরির কাজ শুরু করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১০ বছর পর এখন সেই কোচিং এবং সহায়ক বইয়ের সুযোগ রেখে আইন করতে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইনের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত। আনুষঙ্গিক কিছু কাজ শেষে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। তাঁর আগে আন্তমন্ত্রণালয় সভা করার কথাও ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, এ বিষয়ে আরও কিছু মতামত নেওয়া হবে। এরপর মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে।
১০ বছর ধরে শিক্ষা আইন ‘হবে, হচ্ছে’ করছে। আইনের খসড়া নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা শুরু হলেই এর কাজ থেমে যায়। সমালোচনার মুখে একবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর পর খসড়া ফেরতও আনা হয়। সব সমালোচনা মূলত কোচিং, প্রাইভেট, নোটবই, গাইড বই ও সহায়ক বই ইত্যাদি রাখা নিয়ে।
একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালোভাবে পড়াশোনা হচ্ছে না, অন্যদিকে পরীক্ষার প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে একই ধরনের হচ্ছে। মনে হয়, কোচিং ও সহায়ক পুস্তকের সঙ্গে একধরনের যোগসাজশ রয়েছে।ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
এবারের প্রস্তাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গাইড বই ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক বই ব্যবসার সুযোগ তো রেখেছেই, সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য পত্রপত্রিকায় পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং তার আলোকে সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধও আরোপ করতে চাইছে। কোচিং করার সামর্থ্য নেই, দুর্বল ও মানহীন গাইড বই যারা পড়তে চায় না, সেসব শিক্ষার্থীর জন্য সারা দেশের সেরা শিক্ষকদের লেখা ছেপে আসছে পত্রিকাগুলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করছে, সরকারের অনুমোদন ছাড়া গণমাধ্যম এখন থেকে এটা করতে পারবে না। অথচ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে গণমাধ্যমের এ উদ্যোগে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়ে আসছে।
জানা গেছে, নোট-গাইড তথা সহায়ক বই ব্যবসায়ীরা নানা পন্থায় প্রভাব খাটিয়ে পত্রিকাগুলোয় লেখাপড়ার পাতা প্রকাশের ওপর শর্ত আরোপের এই প্রস্তাব করে আসছে। এটা করতে পারলে সহায়ক বইয়ের ব্যবসায় তাঁরা বাড়তি সুবিধা পাবেন। তবে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলছেন, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একাডেমিক কোচিং এবং সহায়ক বইয়ের (একধরনের নোট-গাইড) সুযোগ রাখলে শিক্ষার মানের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। মূল বই পড়া বা শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়ার অবস্থা আরও খারাপ হবে।
যেভাবে থাকছে কথিত সহায়ক বই
বিদ্যমান একটি আইনে স্কুলপর্যায় পর্যন্ত নোট-গাইড নিষিদ্ধ আছে। ফলে এখন বাজারে সহায়ক পুস্তক বা অনুশীলন বই চলছে, যা মূলত নোট-গাইডের বিকল্প। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা নিষিদ্ধই রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ তা করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড করা যাবে। তবে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক পুস্তক তৈরি, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে। কিন্তু কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তক ক্রয় বা পাঠে বাধ্য করতে পারবে না। করলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। প্রশ্ন উঠেছে, যদি তা–ই হবে, তাহলে কেন সহায়ক বইয়ের সুযোগ রাখা হচ্ছে?
খসড়ায় বলা হয়, কোচিং সেন্টার পরিচালনা এবং সেখানে পড়ানো এই আইনে নিষিদ্ধ বলে গণ্য হবে না। তবে শর্ত হলো, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালে কোচিং করাতে বা করতে পারবে না। করলে ‘উপযুক্ত’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ওই কোচিং সেন্টারের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। কোচিং সেন্টারে শিক্ষক তাঁর নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন না। শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে সরাসরি প্রাইভেট অথবা ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও পড়াতে পারবেন না।
শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেছেন, আইনে নিষিদ্ধ থাকার পরও নোট-গাইড দেদার চলছে। বর্তমানেও একশ্রেণির শিক্ষকের সহায়তায় ব্যবসায়ীরা নানা নামে কথিত সহায়ক পুস্তক শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে সৃজনশীল শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। অথচ সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল পাঠ্যপুস্তক ঠিকমতো পড়ানো গেলে সহায়ক বইয়ের দরকার হতো না। আর নোট-গাইড, সহায়ক বা অনুশীলন বই—যে নামেই হোক, এগুলো শিক্ষার জন্য ভালো কাজ দেয় না। পড়াশোনা হতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই।
কোচিং-প্রাইভেট থাকছে
২০১৬ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো শিক্ষা আইনের খসড়ায় ‘ছায়াশিক্ষার’ নামে কোচিংয়ের বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন সহায়ক বই এবং কৌশলে কোচিংয়ের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে—এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সমালোচনায় পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ফেরত এনে আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর যে খসড়াটি করা হয়, তাতে কোচিং-টিউশনি ও সহায়ক বই বাদ দেওয়া হয়। এর আগেও শিক্ষা আইনের যে খসড়া মতামতের জন্য মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইটে দিয়েছিল, তাতেও বলা হয়েছিল, কেউ প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং করালে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
কিন্তু এবার সহায়ক বইয়ের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারেরও বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে আইনে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং করানোর ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলা হচ্ছে।
খসড়ায় বলা হয়, কোচিং সেন্টার পরিচালনা এবং সেখানে পড়ানো এই আইনে নিষিদ্ধ বলে গণ্য হবে না। তবে শর্ত হলো, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালে কোচিং করাতে বা করতে পারবে না। করলে ‘উপযুক্ত’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ওই কোচিং সেন্টারের নিবন্ধন বাতিল করা হবে। কোচিং সেন্টারে শিক্ষক তাঁর নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন না। শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে সরাসরি প্রাইভেট অথবা ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও পড়াতে পারবেন না।
কোচিং সেন্টার চলবে। তবে শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। শিক্ষার্থীর মঙ্গল বিবেচনায় ‘যৌক্তিকভাবে’ শাসন করা যাবে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দূরশিক্ষণ এবং ই-লার্নিং পদ্ধতিতে কোর্স চালাতে পারবে।
তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বেলায় অভিভাবকদের লিখিত সম্মতিতে স্কুল সময়ের আগে বা পরে সরকারি নিয়ম মেনে অতিরিক্ত ক্লাস করাতে পারবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলছেন, শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনার সুযোগ রাখলে শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনায় আরও বিঘ্ন ঘটবে।
ই-লার্নিং শিক্ষার আইনি রূপ
এত দিন মূলত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ বাস্তবতায় এখন স্কুল পর্যন্তও অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়েছে। এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে ক্লাস প্রচার করা হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, উচ্চতর শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুমোদন নিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে দূরশিক্ষণ এবং ই-লার্নিং পদ্ধতিতে কোর্স বা প্রোগ্রাম পরিচালনা ও ডিগ্রি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে।
শিক্ষার্থীকে ‘যৌক্তিক’ শাসনের সুযোগ
শিক্ষার্থীকে কোনো ধরনের শারীরিক শাস্তি বা মানসিক নিপীড়ন করা যাবে না। কেউ তা করলে শাস্তি পেতে পারেন। তবে শিক্ষার্থীর মঙ্গল বিবেচনায় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার জন্য শিক্ষার্থীকে শিক্ষক ‘যৌক্তিকভাবে’ শাসন করতে পারবেন। ‘সরলমনে’ করলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য শিক্ষক দায়ী হবেন না।
আইনে আরও যা থাকছে
বিদ্যালয়কেন্দ্রিক মূল্যায়নপদ্ধতি এবং পাবলিক পরীক্ষার বিষয় ও সংখ্যা সরকার অনুমোদিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। সরকার নতুন করে শিক্ষাক্রম করছে, যেখানে পরীক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হবে।
প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন বা পাঠদানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বাংলা, ইংরেজি ভার্সনসহ বিদেশি শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পরিচালিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন, টিউশন ও অন্যান্য ফি অযৌক্তিকভাবে বেশি নেওয়া যাবে না। নিলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
সার্বিক বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এখানে উপসর্গ নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। আসল কাজ হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো করে পড়াতে হবে। পড়ানোর বিদ্যমান ধরন বদলাতে হবে। এখন একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালোভাবে পড়াশোনা হচ্ছে না, অন্যদিকে পরীক্ষার প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে একই ধরনের হচ্ছে। মনে হয়, কোচিং ও সহায়ক পুস্তকের সঙ্গে একধরনের যোগসাজশ রয়েছে। তিনি বলেন, কেবল পরীক্ষার প্রশ্ন সৃজনশীল পদ্ধতিতে নয়, শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনাও সৃজনশীল হতে হবে। শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পড়ানো গেলে কোচিং বা সহায়ক পুস্তক এমনিতেই থাকবে না। আর শিক্ষা আইনে যেটি বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত, তা হলো শিক্ষা একটি অধিকার। প্রস্তাবিত আইনে সেটিই কম গুরুত্ব পাচ্ছে।