২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

অনিশ্চিত যাত্রায় শিক্ষা-শিক্ষার্থী

করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ সাড়ে পাঁচ মাস। ​ছুটির বিষয়ে দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে। পাঁচ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে, তা কেউ জানে না। কারণ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। লক্ষণও আশাব্যঞ্জক নয়।

বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে, বেশির ভাগ সে সুবিধার বাইরে। সরকার টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস সম্প্রচার করছে, সেখানে উপস্থিতি ভালো নয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও সমমানের পরীক্ষা এ বছরের জন্য বাতিল করা হয়েছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত এখনো নেই।

সব মিলিয়ে পড়াশোনা ও পরীক্ষা ছাড়াই চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর চেয়েও ভয়ের বিষয় হলো, শিক্ষার্থীদের একাংশ পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়তে পারে। বাল্যবিবাহের হারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়তে পারে শিশুশ্রমও।

এদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস করিয়ে পুরো টিউশন ফি নিচ্ছে। অভিভাবকেরা তা দিতে রাজি নন। বিপরীতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা বেতন না পাওয়া ও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন।

আরও পড়ুন

এই পরিস্থিতি নজিরবিহীন। প্রবীণ শিক্ষকনেতা কাজী ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে জানান, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি। কোনো পাবলিক পরীক্ষাও বাতিল হয়নি।

সংগত কারণে সরকার আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পথেই হাঁটছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে আরেক দফায় ছুটি বাড়ানো নিয়ে আলোচনা চলছে। দু-এক দিনের মধ্যেই ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আকরাম আল হোসেন গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, আপাতত বিদ্যালয় খুলছে না। আজ বৃহস্পতিবার ছুটির বিষয়ে জানানো হতে পারে। তিনি জানান, তাঁরা একাধিক বিকল্প নিয়ে এগোচ্ছেন। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অক্টোবরে খোলার মতো পরিস্থিতি হয়, তাহলে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে নিজ নিজ বিদ্যালয়ে মূল্যায়ন করা হবে। আর নভেম্বরে খুললে আরেক ধরনের সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি অনুযায়ী মূল্যায়ন হবে। আর তাও সম্ভব না হলে বছরের শুরুতে যে আড়াই মাস ক্লাস হয়েছিল, তার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩ কোটি। ইতিমধ্যে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

সংকট প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত থাকলেও বেশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে, যদিও উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা একে তো ছোট, তার ওপর এই দুই স্তরে বাসায় থেকেও পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বড় শহরে কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস নিলেও সেগুলোর বেশির ভাগে পাঠদান এখন পর্যন্ত মানসম্মত হয়নি। কারণ, আগে থেকে প্রস্তুতি ছিল না। যেমন সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দা মোস্তাকিন রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এক সন্তান একটি কিন্ডারগার্টেনে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা থাকলেও স্কুলের মতো ফলপ্রসূ হয় না।

আরও পড়ুন

অনলাইনে পাঠদানে বৈষম্যও আছে। শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়াশোনায় এগিয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে তারা ক্লাস ও পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে অনলাইনে। শহর ও গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। সরকার গত ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার করছে। কিন্তু টেলিভিশনের ক্লাস খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণির ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনের ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে। এর মানে হলো প্রায় অর্ধেক ক্লাস করছে না। মাধ্যমিক স্তরে টেলিভিশনের ক্লাসের চিত্রটিও কমবেশি একই।

এ অবস্থায় ১২ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের ক্লাস প্রচার শুরু হয়। আবার টেলিভিশন ও বেতারে ক্লাস এককেন্দ্রিক হওয়ায় এখানে শিশুরা আনন্দ পায় না। প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই। এসবে ক্লাস হলেও মূল্যায়নের সুযোগ নেই। ফলে এটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

বার্ষিক পরীক্ষার কী হবে

স্কুল বন্ধ করার আগ পর্যন্ত প্রাথমিকে মাত্র ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ বিষয়ভিত্তিক পাঠদান সম্ভব হয়েছিল। প্রাথমিকে প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে। গত মঙ্গলবার পঞ্চম শ্রেণি শেষে কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত এ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাও বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হয়।

এখন সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগামী ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে করোনার যে পরিস্থিতি, তাতে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া যাবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, করোনার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এখন বিদ্যালয় খোলা ঠিক হবে না। তবে ভেতরে-ভেতরে দুই মন্ত্রণালয়ের একটি পরিকল্পনা হলো, অক্টোবর বা নভেম্বরে বিদ্যালয় খুললেও সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে চলতি শিক্ষাবর্ষের পড়াশোনা শেষ করা। প্রথম দিকে শিক্ষাবর্ষ আগামী বছরের দু-তিন মাস বাড়ানোর আলোচনা থাকলেও এখন সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসা হয়েছে।

আরও পড়ুন

মাধ্যমিকেও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে। এখন সামনে আছে জেএসসি ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। সরকারি সূত্রমতে, এই পরীক্ষাও বাতিল করার প্রস্তাব আছে। এ জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এদিকে প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিকেও সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে পড়াশোনা শেষ করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখনই পরিস্থিতি ভালো হবে, তখনই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা উচিত। অটো প্রমোশন ভালো হবে না।’

ফি নিয়ে উভয়সংকট

করোনাকালে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফি নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অভিভাবকেরা বলছেন, কোনোমতে অনলাইন ক্লাস চালু রেখে পুরো টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে, যা তাঁদের চাপে ফেলছে। এ জন্য টিউশন ফি কমানোর দাবি তাঁদের।

স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষ বলছে, টিউশন ফি আদায় না হলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া যাবে না। তাতে আরেক সংকট তৈরি হবে। আর্থিক চিন্তায় শিক্ষকদের অনেকে চান বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হোক, বিশেষ করে বেসরকারি বিদ্যালয়। কারণ, যেসব শিক্ষকের বেতনে সরকারের অনুদান নেই (নন-এমপিও), তাঁদের জীবিকা ঝুঁকিতে পড়েছে।

অবশ্য বিশেষজ্ঞরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনই খোলার বিপক্ষে। তাঁরা মনে করেন, শিক্ষকদের কোনো অসুবিধা হলে সেটা সরকার বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য কাজী ফারুক আহমেদ মনে করেন, বিদ্যালয় খোলার ক্ষেত্রে শুধু বিশেষজ্ঞ নয়, শিক্ষকদেরও মতামত নিতে হবে। তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা দরকার, যাতে আতঙ্ক দূর করা যায়।

খোলা হলে প্রস্তুতি কী

বিদ্যালয় কবে খুলবে তা এখনো ঠিক না হলেও খোলার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে তা কীভাবে চলবে, সে বিষয়েও বেশ কিছু নির্দেশনা তৈরি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাস শুরুর কমপক্ষে ১৫ দিন আগে শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হবে, যাতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা যায়।

পরিকল্পনার মধ্যে আরও রয়েছে: ১. বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা। ২. যেসব স্কুলে টিউবওয়েল বা পানির ব্যবস্থা নেই, সেটার ব্যবস্থা করা। ৩. তিন ফুট দূরত্বে বসা নিশ্চিত করা। ৪. ক্লাসে শিক্ষার্থী বেশি হলে কোন দিন কোন ক্লাস এবং কোন শ্রেণির ক্লাস হবে, তা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে। ৪. স্কুলে থাকা শিক্ষার্থীর হঠাৎ করোনার উপসর্গ দেখা দিলে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবস্থা নেবে। স্কুলে জরুরি সেবার মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে। ৫. সরকার যদি কোনো এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করে, তাহলে ওই এলাকার স্কুল খুলবে না।

আরও পড়ুন

‘ঝরে যাতে না পড়ে’

করোনার প্রভাবে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ঝরে পড়াও বাড়বে। বাড়বে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম। এ আশঙ্কা উঠে এসেছে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায়।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ মনে করেন, শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে, এটি মাথায় নিয়েই শিক্ষা উদ্ধার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। কারণ, এখনো বলা যাচ্ছে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন শিক্ষকদের কাজে লাগিয়ে মোবাইল ফোন হোক বা অন্য যেকোনোভাবেই হোক, শিক্ষার্থীদের সংযোগ তৈরি করে তাদের সক্রিয় রাখতে হবে। তাদের মানসিক স্বস্তি দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে।