সংখ্যা আবিষ্কারের ইতিহাসের একদম শেষ সীমানায় আছি আমরা। আজকে জানব মায়া সভ্যতার সংখ্যাপদ্ধতি এবং আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী আধুনিক সংখ্যাপদ্ধতির আবির্ভাবের ইতিহাস নিয়ে!
আগের পর্বগুলোয় আমরা যেসব সংখ্যাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, সেগুলো কোনো না কোনোভাবে একে–অপরের নিকট অথবা দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল। কিন্তু মায়া সভ্যতা অনেকটাই আলাদা। এদের সঙ্গে কোনো সংখ্যাপদ্ধতির মিল ছিল না। কারণ, তারা শূন্যের ব্যবহার জানত এবং সেটা তাদের সংখ্যাপদ্ধতিতে উল্লেখ করেছে! লাতিন আমেরিকার এই সভ্যতা সম্পর্কে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মানুষেরা জানতে পেরেছে মাত্র ৫০০ বছর আগে। অথচ মায়া সভ্যতার বিকাশকাল আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে। মায়া সভ্যতা সম্পর্কে লোকমুখে অনেক রহস্যময় কাহিনি প্রচলিত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ক্যালেন্ডারের জন্য মায়া সভ্যতা সবচেয়ে বেশি পরিচিত। কিন্তু সমস্যা ছিল যে তাদের ক্যালেন্ডারে ২০১২–এর পর আর কোনো সাল ছিল না। এর থেকেই একটা কথা প্রচলিত হয়ে গেল যে তারা বিশ্বাস করত, ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা নিছক পাগলামি আরকি! কারণ, এখন ২০২২ সাল আর পৃথিবীটা দিব্যি বেঁচে আছে।
সে যা–ই হোক, মায়া সভ্যতায় সংখ্যাপদ্ধতির বিকাশ ঘটেছিল একদম স্বতন্ত্রভাবে। তাদের সংখ্যাপদ্ধতি ছিল ৫ ভিত্তিক এবং অবাক করা ব্যাপার হলো, মায়ারা শূন্যের জন্য আলাদা প্রতীক ব্যবহার করত। শূন্য, ১ ও ৫ বোঝাতে তারা শুধু আলাদা প্রতীক ব্যবহার করত। অন্য সব সংখ্যা লিখত এই তিনটি প্রতীক ব্যবহার করে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে আধুনিক পদ্ধতির অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল মায়ারা। তবে যোগ-বিয়োগের জন্য মায়াদের পদ্ধতিও বিশেষ সুবিধার ছিল না।
এত ইতিহাস পর্যালোচনা করার পর এবার সময় ঘরে ফেরার। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য তথা আধুনিক সংখ্যাপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে এই ইতিহাস পর্ব ক্লোজ করব। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে আমরা সংখ্যা লিখি, সেটা প্রাচীন ভারতীয় ও আরবদের সম্মিলিত অবদানের ফসল। ০ থেকে ৯ পর্যন্ত মোট ১০টি অঙ্ক ব্যবহার করে যেকোনো সংখ্যা লিখতে পারার বর্তমান পদ্ধতিটি ভারতীয়রা আবিষ্কার করেছিল প্রায় ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। যদিও খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক থেকেই এই পদ্ধতির যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন, তবে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের আগের কোনো লিপিবদ্ধ প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
ভারতীয় পদ্ধতিতে যোগ-বিয়োগের হিসাব সে সময়ে আরবে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ছিল অনেক সহজ ও কার্যকর। দারুণ পদ্ধতিটি তাই আরবদের মনে ধরে গেল খুব সহজে। ভারত থেকে শিখে আসা পদ্ধতি আরবরা ছড়িয়ে দিল সারা বিশ্বে। আরবিতে শূন্যকে বলা হয় সিফর। আরব বণিকদের কাছে শেখা শূন্য বা সিফরকে ইতালীয়রা লাতিনে বলত জেপিরো। আর লাতিন জেপিরো থেকেই এসেছে ইংরেজি জিরো শব্দটি। যদিও ইতালীয় বণিকেরা জানত ইন্দো-আরবীয় পদ্ধতিতে হিসাব–নিকাশ খুব সহজে করা যায়, তারপরও ভিনদেশিদের পদ্ধতি বলে বাণিজ্য ছাড়া আর অন্য কোনো কাজে তারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে চাইত না। তবে অচিরেই ইউরোপে জনপ্রিয়তা লাভ করে ইন্দো-আরবীয় পদ্ধতি।
আর এই জনপ্রিয়করণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন যে মানুষটি, তার নাম লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি (১১৭০–১২৫০); ফিবোনাচ্চি সংখ্যার গল্প নিয়ে গণিত ইশকুলের লেখায় যার নাম পড়েছ তোমরা।
এই ফিবোনাচ্চির নামানুসারেই কিন্তু নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত ফিবোনাচ্চি সিরিজের, যদিও সংস্কৃত ছন্দ প্রকরণে ফিবোনাচ্চি সিরিজের ব্যবহার বহু শতাব্দী আগে থেকেই ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফিবোনাচ্চি সেখান থেকেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন এ ধারাটির প্রতি। প্রথম ছন্দ প্রকরণে ফিবোনাচ্চি ধারা ব্যবহার করেন খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের ভারতীয় পণ্ডিত পিঙ্গলা। আর এটাই অদ্যাবধি জানা ফিবোনাচ্চি সিরিজ ব্যবহারের প্রাচীনতম নজির!
এই ফিবোনাচ্চি সিরিজ আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় নয়। তবে চেষ্টা করব সংখ্যাতত্ত্বের এই আলোচনার কোনো একটা পর্বে এটা নিয়ে লেখার। ভারতীয় আর আরবীয়দের প্রয়োজনের খাতিরে আমরা পেয়েছি একটা সুন্দর, নির্ভুল ও সহজ সংখ্যাপদ্ধতি। মানবসভ্যতাকে সেই মাল, বুলান, গুলিবা থেকে তুলে এনে শূন্য (0), এক (১), দুই (২), তিন (৩), চার (৪), পাঁচ (৫), ছয় (৬), সাত (৭), আট (৮), নয় (৯) পর্যন্ত নিয়ে আসার যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। অনেক জাতির, অনেক গোষ্ঠীর মিলিত চেষ্টায় আজকের আমাদের ১০ ভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি পেয়েছি। আর তাই সংখ্যার গল্প এত্ত মজার!