সোফি : আমৃত্যু এক হার না মানা প্রাণ
সোফি জার্মেইন, প্যারিসের এক মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৩ বছর, তখন ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই সোফির বিদ্যালয়ের শিক্ষা অর্জন হয়নি। বেশির ভাগ সময় তাঁর বাবার গ্রন্থাগার থেকেই পড়াশোনা করতেন।
রোমান বাহিনী কর্তৃক ঘেরাও হওয়ার পরও আর্কিমিডিসের অবিরতভাবে গণিতচর্চা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি তাঁর মনে এতটা প্রভাব ফেলেছিল যে তিনি গণিতবিদ হওয়ার পরিকল্পনা স্থির করে ফেলেন। এরপর মা–বাবাকে বলেন যে তিনি একজন গণিতবিদ হতে চান। কিন্তু সে সময় সমাজে মেয়েদের গণিতচর্চা একদম হতো না বললেই চলে। গণিত নিয়ে পড়াশোনা মেয়েদের কাজ নয়, এ রকম মনোভাবও ছিল।
ফলস্বরূপ যা হওয়ার তা–ই হলো। তাঁর মা–বাবাও গণিতবিদ হওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে গণিত নিয়ে পড়াশোনা থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলেন নানাভাবে।
শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে একান্ত প্রচেষ্টায় গণিত, বিজ্ঞানের উন্নয়নে কাজ করে গিয়েছিলেন সোফি জার্মেইন; কোনো সম্মাননা বা পুরস্কারের আশা না করে। আর মেয়েদের শিক্ষা অর্জনের বাধাগুলো দূরীভূত করতেও তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।
এরপরও লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যান। এরই মধ্যে ক্যালকুলাস আয়ত্ত করে ফেলেন এবং উচ্চতর ক্যালকুলাসের বই পড়ার লাতিন ও গ্রিক ভাষা শিখে নেন।
শোনা যায়, একদিন সোফির মা–বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁকে বাবার লাইব্রেরিতে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে মেঝেতে ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন। (আসলে তিনি লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করতেন রাতের বেলা, যাতে মা–বাবার নজর এড়াতে পারেন)। ঘটনাটি তাঁর মা–বাবার মনে প্রভাব ফেলে। তাঁরা জার্মেইনের পড়াশোনার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা অনেকটা কমান।
১৮ বছর বয়সে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইকোল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন সোফি জার্মেইন। তিনি পড়াশোনা, নোট সংগ্রহ ইত্যাদি কাজ করতেন একটি ছেলের ছদ্মনামে (M. LeBlanc নামে)। সে সময় ল্যাগ্রাঞ্জ সেখানকার শিক্ষক ছিলেন। তিনি তাঁর কোর্সটি শেষ করে শিক্ষার্থীদের একটি অ্যাসাইনমেন্ট দেন। জার্মেইন সেটির সমাধান করে পেপার সাবমিট করেন; তবে ছদ্মনামেই। ল্যাগ্রাঞ্জ পেপারটি দেখে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। পরে এটি যে একজন মেয়ে লিখেছে, তা জানতে পেরে অত্যন্ত অভিভূত হন। তিনি সোফির কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব নেন।
এরপর কার্ল ফ্রেডরিক গাউসের (বিখ্যাত গণিতবিদ) সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গণিতের বিশেষত সংখ্যা তত্ত্বের নানা সমস্যা নিয়ে গাউসের সঙ্গে তাঁর চিঠি আদান-প্রদান হতো প্রায় সময়। তবে তখনো ছদ্মনামই ব্যবহার করতেন। গাউসের কাছে তাঁর পরিচয় প্রকাশিত হয় অনেকটা পরিস্থিতির শিকার হয়ে (১৮০৭ সালে)। কেননা তখনো ফ্রান্সে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছিল এবং গাউস তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জার্মেইনের সঠিক পরিচয় জানতে চান। জার্মেইন যদিও ভয়ে ছিলেন যে পরিচয় জানার পর গাউস হয়তো তাঁকে গুরুত্ব দেবেন না কিংবা চিঠির জবাবও দেবেন না; কিন্তু গাউস তাঁকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন এবং নানাভাবে তাঁর গবেষণায় সাহায্য করেছিলেন।
১৮১১ সালে ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্সের একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। এটি ছিল পদার্থের কম্পন নিয়ে জার্মানের পদার্থবিদ ক্লাডিনসের একটি পরীক্ষামূলক বিষয়ের ওপর। এর সমাধান কেউ না পারায় ১৮১৩ ও ১৮১৬ সালে আয়োজন করা হয় প্রতিযোগিতাটি। তৃতীয়বারের চেষ্টায় সোফি জার্মেইন সফল হন এবং পুরস্কার পান। পুরস্কার পাওয়ার পর বিজ্ঞান ও গণিতবিদদের মহলে তাঁর কদর অনেক বেড়ে যায়। অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর।
১৮১৯ সালে ফার্মাট’স লাস্ট থিওরেমের একটি সাধারণ রূপের সমাধান লিখে গাউসকে পাঠান। ফার্মার এই উপপাদ্যে বলা হয়েছে- x, y, z, n ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা এবং n-এর মান ২–এর চেয়ে বড় হলে x×n+y×n=z×n–এর পূর্ণসংখ্যায় কোনো সমাধান নেই। সোফি জার্মেইন এর একটি বিশেষ রূপ প্রমাণ করেছিল যে x, y, z, n যদি সহমৌলিক সংখ্যা হয় এবং n ১০০–এর চেয়ে ছোট হয়, তাহলে এর পূর্ণসংখ্যায় কোনো সমাধান নেই। এটি ১৮২৫ সালে লেজেন্ড্রার (গণিতবিদ) একটি বইয়ে দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল।
পরে তিনি আবার স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন আমৃত্যু।
তাঁর অন্য কাজগুলোর মধ্যে সোফি জার্মেইন প্রাইম, সোফি জার্মেইন উপপাদ্য, গড় বক্রতল (Mean curvature), জার্মেইন-ল্যাগ্রাঞ্জ প্লেট সমীকরণ ইত্যাদির অবদান অনস্বীকার্য।
১৮২৯ সালে ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার দুই বছর পর তিনি মারা যান। ওই বছরই গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের ব্যবস্থা করেছিলেন গাউস, কিন্তু তিনি তা অর্জনের আগেই মারা যান। এরপরও তাঁকে ও তাঁর কাজগুলোকে সবার সামনে আনতে গাউসের অবদান ছিল অনেক।
গণিতে অবদানের জন্য ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্স ‘সোফি জার্মেইন প্রাইজ’ নামে একটি পুরস্কার চালু করে ২০০৩ সাল থেকে।