গণনাযন্ত্রের ময়নাতদন্ত (পর্ব ৫)
আজকের পর্বে আমরা মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটর নিয়ে জানব। তবে আগেই বলে রাখছি, খুব বিস্তারিত আলোচনায় যাব না আমরা। কেননা, এগুলোর সঙ্গে আমাদের গণিতের তেমন বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। পদার্থবিজ্ঞানকে ব্যবহার করে এগুলো বানানো, কেবল তোমাদের একটা ধারণা দেব এগুলো নিয়ে। তবে এগুলোর মেকানিজম ও বিস্তারিত জানার জন্য কিছু আর্টিকেল রেকমেন্ড করে দেব, তোমরা সেগুলো ফলো করতে পারো।
১৬৪২ সালে গণিতবিদ ব্লেইস প্যাসকেল একটি ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন, যা ছিল মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটরের সূচনা। এটিকে প্যাসকেলাইন ক্যালকুলেটর হিসেবে নামকরণ করা হয়। তবে তাঁর ক্যালকুলেটরে কেবল দুইটি সংখ্যার মধ্যে অনেক ধরনের অপারেশন করার ব্যবস্থা ছিল। তাঁর মেশিনের মূল অংশ ছিল একটি ক্যারি মেকানিজম, যা একটি ডায়ালে ১ থেকে ৯ যোগ করে। যখন ডায়ালটি ০-তে পৌঁছানোর জন্য চালু করা হয়, তখন পরবর্তী ডায়ালটি ১ ক্যারি করতে পারত। এটি প্রতিটি ডিজিটকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তোলে, যা একাধিক ক্যারিকে দ্রুত এক ডিজিট থেকে অন্য ডিজিটে ক্যাসকেড করে।
১৬৪২ ও ১৬৪৫–এর মধ্যে তিনি ৫০টির বেশি প্রোটোটাইপ তৈরি করেন এবং চূড়ান্ত নকশাটি জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করার মাধ্যমে ফ্রান্সের তৎকালীন চ্যান্সেলর পিয়েরে সেগুয়েরকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি পরবর্তী কয়েক দশক ধরে তাঁর নকশার উন্নতি করেন এবং অবশেষে ফ্রান্সে যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর ডিজাইন এবং নির্মাণের জন্য তাঁকে রয়্যাল প্রিভিলেজ (একটি পেটেন্টের সমতুল্য) প্রদান করা হয়েছিল।
আজ তাঁর আসল মেশিনের ৯টি উদাহরণ রয়েছে, যা ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। তবে এগুলো সবই ম্যানুয়াল ডিভাইস ছিল, হয় কোনো চাবি ঘুরিয়ে নতুবা কোনো চাকা সেট করে হিসাব–নিকাশ করা হতো।
মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটর নিয়ে আলোচনা আটলান্টিক পেরিয়ে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে যায় বিভিন্ন হ্যান্ড-ক্র্যাঙ্কযুক্ত মেকানিজমের বিকাশের সঙ্গে। এরই মধ্যে ১৮৭৭ সালে নির্মিত হয় গ্র্যান্ট মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটিং মেশিন এবং ১৮৮৬ সালে উইলিয়াম সেওয়ার্ড বারোস দ্বারা তৈরি বিখ্যাত P100 Burroughs অ্যাডিং মেশিনের মেকানিজমও ছিল। এরই মধ্যে P100 অ্যাডিং মেশিন তার উদ্ভাবক বুরোস এবং তার কোম্পানির জন্য অনেক লাভজনক হয়ে ওঠে।
এর কিছুদিনের মাথায় ১৮৮৭ সালে ডর ই ফেল্ট তাঁর কম্পটোমিটারের জন্য একটি মার্কিন পেটেন্ট পান, যা তৎকালীন ক্যালকুলেটরকে পুশ বোতামের যুগে নিয়ে গেছে এবং পরবর্তী কয়েক দশক এটাকে নিয়েই নানা প্রকার কাজ হয়েছে। পুশ বোতামের সংযোজন ক্যালকুলেটরের সিমুনটেনিয়াসলি যোগ, বিয়োগসহ হিসাব–নিকাশ দ্রুত করতে অনেক কাজে দেয়। এতে একটা সংখ্যা ইনপুট দেওয়ার পরে পুশ বাটন প্রেস করে অপর সংখ্যা ইনপুট দেওয়া যেত, যাতে ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটরের বদলে কম্পটোমিটারের মতো ডিভাইসকে দ্রুত ও সহজে ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছিল সবার কাছে।
১৯৪০ সাল নাগাদ মেকানিক্যাল ক্যালকুলেটরগুলো আরও পোর্টেবল হয়ে যায়। এর মধ্যে কার্টা ক্যালকুলেটর মোটামুটি ছোট ছিল, এক হাতে ফিট হতে পারে আবার পকেটেও বহনযোগ্য। আসলে এটিই ছিল প্রথম, শেষ ও একমাত্র যান্ত্রিক হ্যান্ডহেল্ড পকেট ক্যালকুলেটর। পুরো মেকানিজম একটা ছোটখাটো সিলিন্ডারের মধ্যে সেট করে বানানো। এই ক্যালকুলেটর মানুষের হাতেই যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করতে পারত, যা বহু বছর ধরে ডি ফ্যাক্টো পোর্টেবল ক্যালকুলেটর হিসেবে বাজারে জায়গা ধরে রাখে।
এরপরই যাত্রা শুরু করে আমাদের আজকের ইলেকট্রিক ক্যালকুলেটর। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে বড় আকারের যুদ্ধের কামান, যুদ্ধজাহাজের বন্দুকের ব্যাটারি, বোমা দর্শন ও অন্যান্য অস্ত্রের প্রয়োজনীয় হিসাব–নিকাশে নির্ভুল ত্রিকোণমিতিক হিসাবের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। এগুলো মূলত ইলেকট্রনিক আউটপুট তৈরি করতে গিয়ারযুক্ত চাকা ও ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডার ব্যবহার করে, যার পরিধি কিংবা ব্যাসার্ধ হিসাব করতে ত্রিকোণমিতি প্রয়োজন।