বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
মাত্র দুটি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়।
বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করেছে। তবে অনেকগুলো পরিণত হয়েছে সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে।
ঢাকার মিরপুরের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (সিইউএসটি) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে। এই ছয় বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি মাত্র দুটি বিভাগ খুলতে পেরেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির শ্রেণিকক্ষ ও অন্যান্য সুবিধার জন্য জায়গা আছে মাত্র ১০ হাজার বর্গফুট।
যদিও আইন অনুযায়ী, একটি সাময়িক অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি বিভাগ থাকতে হবে এবং জায়গা থাকতে ২৫ হাজার বর্গফুট। এসব নিয়ম না মানলেও সিইউএসটিতে শিক্ষার্থী ভর্তি চলছে।
এটি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। সব মিলিয়ে অন্তত ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এ বছরের বিভিন্ন সময়ে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সব কটিই বিভিন্ন মাত্রায় অনিয়ম পাওয়া গেছে। যার বিপরীতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছে।
আরও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে জানিয়ে ইউজিসির পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ওমর ফারুখ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত করা হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। আবার নিজস্ব এখতিয়ার অনুযায়ী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ইউজিসি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইউজিসির অবস্থান হলো, এখন অনিয়ম করলে কেউ আর ছাড় পাবে না।
২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে।
তদন্তের মুখে যারা
দেশে ১৯৯২ সাল থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ানো ও বিদেশে শিক্ষার্থীদের চলে যাওয়া নিরুৎসাহিত করা। এখন পর্যন্ত দেশে ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শুরুর দিকে গ্রহণযোগ্য উদ্যোক্তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন। এতে দেশে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, যারা পড়াশোনার মান বজায় রেখেছে। অবশ্য ২০০১ সালের পর রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে, যা এখনো চলছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সনদ বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ইউজিসি চলতি বছরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তদন্ত করেছে এবং করছে তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটি, চুয়াডাঙ্গার ফাস্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, মানিকগঞ্জের এনপিআই বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তা মানে, বেশির ভাগই তা মানে না। ইউজিসি এসব নিয়মকানুন মানাতে পারছে কি না, সেটাও একটি প্রশ্ন।
দুই বিভাগ, চার শ্রেণিকক্ষ
সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (সিইউএসটি) নিয়ে ইউজিসি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় গত ২৭ এপ্রিল। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টি ইস্পাতের কাঠামোর একটি দ্বিতল ভবনে অবস্থিত। এতে শ্রেণিকক্ষ মাত্র তিনটি। লাইব্রেরি, মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, অফিসকক্ষ, শিক্ষার্থীদের পৃথক কমন রুমসহ অন্যান্য সুবিধার জন্য আলাদা জায়গা নেই। মিরপুর ১৫ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গত সোমবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, ইউজিসির তদন্তদল গত এপ্রিলে যে ইস্পাতের কাঠামোর ভবনে তিনটি শ্রেণিকক্ষ দেখেছিল, সেই ভবনেই বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম চলছে। তবে একজন কর্মী জানান, এখন চারটি শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ভর্তি শাখায় গিয়ে জানা গেল, স্নাতক পর্যায়ে শুধু বিবিএ ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম চলছে। চার বছর মেয়াদি বিবিএ পড়ার জন্য নির্ধারিত মোট ব্যয় ৪ লাখ ১ হাজার টাকা এবং কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (সিএসই) ৫ লাখ ৩ হাজার টাকা। তবে শিক্ষার্থী ভর্তিতে তারা উচ্চহারে ছাড় দিয়ে থাকে।
সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ট্রাস্টি বোর্ড নিয়েও জটিলতা আছে। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত শিশুচিকিৎসক অধ্যাপক এম আর খান। তিনি মারা গেলে চেয়ারম্যান হন গাজী এম এ সালাম। তিনিও মারা গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে ট্রাস্টি হিসেবে শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ কায়কোবাদসহ আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে। তবে অধ্যাপক কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বহু আগেই বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছেন।
বক্তব্য জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য মঞ্জুর হোসেনকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। ইউজিসির তদন্ত কমিটির সুপারিশ হলো, এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুটের ভবন নিশ্চিত করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। নইলে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করতে হবে।
নামে বিশ্ববিদ্যালয়, ভর্তি বন্ধ
কুমিল্লায় ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। গত এপ্রিলে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ইউজিসি বলেছিল, সেখানে শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি অনুপস্থিত। ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে চলছে একাধিক মামলা এবং সদস্যদের বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির অভিযোগ। এ ছাড়া শিক্ষকসংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে, গবেষণা নেই।
তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, গত এপ্রিলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় ইউজিসি। এখনো তা বন্ধ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন কর্মকর্তা সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোনো উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই।
শিক্ষকদের বেতন এত কম
২০১২ সালে চুয়াডাঙ্গায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি। গত ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে ইউজিসির তৈরি করা এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বেতন বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখানে শিক্ষকদের বেতন ৯ হাজার থেকে সাড়ে ২৮ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রার নেই। সহকারী রেজিস্ট্রার নাফিউল ইসলাম জোয়ার্দ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসি যে তথ্যের কথা বলেছে, সেটি আসলে খণ্ডকালীন শিক্ষকদের তথ্য। বর্তমানে প্রভাষকদের শুরুতে বেতন ২২ হাজার টাকা। বাড়িভাড়া এর মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে সহকারী অধ্যাপকদের সাড়ে ২৯ হাজার, সহযোগী অধ্যাপকদের সাড়ে ৩৫ হাজার ও অধ্যাপকদের ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
অবশ্য শিক্ষকেরা মনে করেন, সাকল্যে ২২ হাজার টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পড়ানোর মতো শিক্ষক পাওয়া সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সংগঠক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চশিক্ষা একটি বিশেষায়িত বিষয়। এ পর্যায়ে যাঁরা পড়ান, তাঁদের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এত কম বেতন দেখে বোঝাই যায়, প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য আসলে ব্যবসা।
আরও অনিয়ম
ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটি ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। ছয় বছরে তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা। তারা তা পারেনি। সেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষকও নেই। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়টির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আলাউদ্দিন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, নিজস্ব ভবন ও ক্যাম্পাসের জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে।
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বর্তমান ক্যাম্পাস ‘মোটেও শিক্ষার্থীবান্ধব নয়’ বলে উল্লেখ করে তা স্থানান্তর না করা পর্যন্ত ইউজিসি গত মে মাসে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ ঘোষণা করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার সুকুমার দত্ত সোমবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, শর্ত সাপেক্ষে তাঁরা শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন পেয়েছেন। আর ক্যাম্পাসের জমি কেনা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে অনুমোদিত আসনসংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তির প্রমাণ পায় ইউজিসি। আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির কার্যক্রমের আইনি কোনো ভিত্তি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ইউজিসির পক্ষ থেকে।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তা মানে, বেশির ভাগই তা মানে না। ইউজিসি এসব নিয়মকানুন মানাতে পারছে কি না, সেটাও একটি প্রশ্ন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, ফরিদপুর ও প্রতিনিধি, চুয়াডাঙ্গা]