বিনা মূল্যের পাঠ্যবই
ছাপার কাজে দেরি, বছরের শুরুতে সব বই পাবে না শিক্ষার্থীরা
প্রাক্–প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত মোট পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৪০ কোটির বেশি।
প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির প্রায় সাড়ে ৪ কোটি বই ছাপা শুরু।
চতুর্থ থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরুর প্রক্রিয়াগুলো পুরোপুরি শেষ হয়নি।
রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায় একটি ছাপাখানায় বই ছাপার কাজ চলছে। এর পাশাপাশি চলছে বই বাঁধাইয়েরও কাজ। ছাপাখানার কর্মীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ব্রাইট প্রিন্টিং প্রেস লিমিটেড নামের ওই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম জানালেন, তাঁরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ছাপার কাজ শেষ করেছেন। এখন তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে।
প্রতিষ্ঠানটি প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৩ লাখ ২৮ হাজারের মতো বই ছাপার কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ বই সরবরাহ করা হয়েছে। শিগগির বাকি বই ছাপার কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক।
শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, বই পরিমার্জন, নতুন দরপত্র দেওয়াসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার অগ্রগতি ভালো। তবে চতুর্থ থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা শুরুর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছরের শুরুতে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, বই পরিমার্জন, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র দেওয়াসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
দেশে উৎসব করে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয় ২০১০ সালে। তবে বিগত দু-তিন বছর
শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ১ জানুয়ারি উৎসব করে বই বিতরণ শুরু হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব নতুন বই দেওয়া যায়নি। দরপত্রসংক্রান্ত জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে এমনটি হয়েছিল। এবার অবশ্য উৎসব করে পাঠ্যবই দেওয়া হবে না।
এবার বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত মোট পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৪০ কোটির বেশি। এসব পাঠ্যবই প্রণয়ন ও ছাপার কাজের দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সব বই অর্থাৎ ১০ কোটি বই ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপা হয়ে যাবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বইও ছাপা শুরু হয়েছে। আর নবম-দশম শ্রেণির বই ছাপার বিষয়ে ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী শনি বা রোববার ছাপার কার্যাদেশ দেওয়া হতে পারে।
শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে মাত্র ১৮ দিন বাকি। এমন পরিস্থিতিতে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই বছরের শুরুতে পাবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের বই আগে ছাপানোর তাঁরা পরিকল্পনা নিয়েছেন। এভাবে তাঁরা প্রাথমিকের ১০ কোটি এবং মাধ্যমিকের প্রায় ১০ কোটি মিলিয়ে মোট ২০ কোটি বই ১ জানুয়ারির মধ্যে দিতে পারবেন। বাকি বই পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে ছাপা হয়ে যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন।
এগিয়ে প্রাথমিক, পিছিয়ে মাধ্যমিক
এনসিটিবির সূত্রমতে, বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য এবার প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি। এগুলোর ছাপার কাজ চলছে। এনসিটিবির লক্ষ্য হলো, এসব বই ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপা শেষ করা।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবই চার কোটির বেশি। এসব বই ছাপার লক্ষ্যে গত সোমবার মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যাদেশ (নোটিশ অব অ্যাওয়ার্ড বা নোয়া) দেওয়া হয়েছে। যদিও গত মঙ্গলবার পর্যন্ত চুক্তির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। সাধারণত চুক্তির পর প্রায় দেড় মাসের মধ্যে বই ছাপিয়ে দিতে বলা হয়। তবে প্রাথমিকের স্তরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় দুই লাখ পাঠ্যবই ছাপার কাজ চলছে। এ ছাড়া প্রাক্-প্রাথমিকের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৬২ লাখের মতো।
এনসিটিবির সূত্রমতে, ষষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণির জন্য এবার মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩১ কোটি। এর মধ্যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার কার্যাদেশ দেওয়ার পর এখন চুক্তির কাজ চলছে। এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, কার্যাদেশের পর কাজ শুরু করতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় না। এ ছাড়া গত বুধবার নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার কাজের জন্য অর্থের বিষয়ে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এসব পাঠ্যবই ছাপার গুণ-মান দেখার জন্য এনসিটিবি ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বাইরে আলাদা পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান কাজ করে। দরপত্রের মাধ্যমে পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান ঠিক করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাধ্যমিকে এবার পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান ঠিক করতে দেরি হয়েছে। গত মঙ্গলবার পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা হয়েছে।
পরিমার্জন, নতুন করে দরপত্র
চলতি বছর পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে। বাকি শ্রেণিগুলোতে আগামী বছর নতুন শিক্ষাক্রম চালুর কথা ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই পরিমার্জন করে ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রক্রিয়ায় বই পরিমার্জনের কাজ ও কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে দরপত্রের কারণে ছাপার কাজে কিছুটা দেরি হবে—এটা অনুমেয় ছিল। কিন্তু এখন যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ধারণার চেয়েও ছাপার কাজ শেষ হতে আরও বেশি দিন লাগতে পারে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান প্রথম আলোকে বলেন, এবার বিভিন্ন কারণে ছাপার কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। আবার কাগজের সংকটও আছে। তাঁরা প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগে শতভাগ দিতে পারবেন বলে আশা করছেন। তিনি বলেন, চতুর্থ থেকে নবম-দশম শ্রেণিতে কয়েকটি করে পাঠ্যবই দিয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু করার ব্যবস্থা করতে এনসিটিবিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেটা এনসিটিবি বিবেচনা করছে।
মান নিয়ে শঙ্কা
অতীতে দেখা গেছে, বছরের শেষ সময়ে একশ্রেণির মুদ্রণকারী নিম্নমানের পাঠ্যবই দেওয়ার পাঁয়তারা করে থাকেন। এবারও এমন অভিযোগ উঠেছে। যেমন নতুন করে ছাপা দ্বিতীয় শ্রেণির একটি পাঠ্যবইয়ে দেখা গেছে, এক পৃষ্ঠার ছবি আরেক পৃষ্ঠায় দেখা যায়। আবার কাগজের নির্ধারিত পুরুত্ব ও উজ্জ্বলতা অনুযায়ী সব বই পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা আছে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের ৬০-৭০ হাজারের মতো বই বাতিল করা হয়েছে। মানের বিষয়ে তাঁরা কোনো ছাড় দেবেন না।