স্কুলে বই গেছে কম, লেখাপড়া টেনেটুনে
মতিঝিলে অবস্থিত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের করিডরে হাঁটাহাঁটি করছিল ছেলেটি। সে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। শিক্ষাবর্ষ শুরুর ১৯ দিনের মাথায় এসে গতকাল রোববারই সে এনসিটিবির বই পেয়েছে। তবে সব নয়, ১৩টি বইয়ের মধ্যে মাত্র ৩টি বই (সপ্তবর্ণা, আনন্দপাঠ ও ইংরেজি) পেয়েছে। সে বলল, বাসায় পিডিএফ ডাউনলোড করা হয়েছে।
একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইংরেজি ভার্সনে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরেক ছাত্র জানাল, সে এখনো একটি বইও পায়নি। শিক্ষকেরা ক্লাসে শিট (ডাউনলোড করা প্রিন্ট কপি) দেখে পড়ান। আর বাসায় সে ওয়েবসাইট দেখে পড়ে।
ইংরেজি ভার্সনের বিদ্যালয় বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে গিয়ে জানা গেল, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই বৃহস্পতিবার এসেছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই এখনো পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক জানালেন, বাংলা ভার্সনের প্রাথমিক স্তরের সব পাঠ্যবই পেয়েছেন, যা বিতরণ করা হয়েছে। আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির তিনটি, সপ্তম শ্রেণির তিনটি, অষ্টম এবং নবম শ্রেণির দুটি এবং দশম শ্রেণির চার বিষয়ের বই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি ভার্সনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কোনো বই এখনো আসেনি। এই বিদ্যালয়ে মতিঝিল শাখায় বাংলা মাধ্যমে শিক্ষার্থী সাত হাজারের বেশি। আর ইংরেজি ভার্সনে পড়ে তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।
তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণের এই চিত্র কেবল ঢাকার এই পরিচিত বিদ্যালয়ের নয়, গ্রাম থেকে শহর—কমবেশি সবখানেই এমন চিত্র। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ঢাকাসহ দেশের সব কটি বিভাগের অধীন অন্তত ২৫টি বিদ্যালয়ে গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনো বিদ্যালয়েই সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব নতুন বই পায়নি। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বই পেয়েছে। কিন্তু চতুর্থ থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধিকাংশ বিষয়ের বই এখনো পায়নি শিক্ষার্থীরা। মূলত বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের বই পেয়েছে তারা। তবে সব শিক্ষার্থী পায়নি। এমন অবস্থায় পড়াশোনা চলছে অনেকটা টেনেটুনে। ঠিকঠাক ক্লাস হচ্ছে না, উপস্থিতিও কম। শিক্ষকদের কেউ কেউ ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে পড়াচ্ছেন। কোথাও পড়ানো হচ্ছে পুরোনো বই। কোনো কোনো শিক্ষক পড়াচ্ছেন অভিজ্ঞতা থেকে। কোনো কোনো বিদ্যালয় বইয়ের পড়াশোনার বাইরে মৌলিক বিষয়গুলো শেখাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীও পিডিএফ ডাউনলোড করছে।
শিক্ষা বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, সব পেতে ফেব্রুয়ারি লেগে যাবে। কিন্তু বাস্তবে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রাথমিকের সব বই হয়তো ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু মাধ্যমিকের সব বই পেতে মার্চ মাস লেগে যেতে পারে বলে মনে করছেন ছাপাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের বেলঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুত্তালিব মৃধা জানালেন, তাঁরা অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে ক্লাস নিচ্ছেন। বোর্ডে লিখে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে যতটুকু পাচ্ছে তুলে নিচ্ছে।
১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাবর্ষে চার কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৪০ কোটি ১৫ লাখ বই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের মোট পাঠ্যবই ৯ কোটির বেশি। এর মধ্যে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ছাড়পত্র (প্রাক্-সরবরাহ পরিদর্শন বা পিডিআই) হয়েছে ৬ কোটির বেশি। অর্থাৎ ৬৫ শতাংশের বেশি পাঠ্যবই সরবরাহ করা হয়েছে।
মাধ্যমিকে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) বইয়ের সংখ্যা ৩০ কোটি ৯৬ লাখের মতো। এনসিটিবির সূত্রমতে, ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৬ কোটি ২৫ লাখের বেশি পাঠ্যবইয়ের ছাড়পত্র বা সরবরাহ করা হয়েছে। অবশ্য ছাপা হয়েছে ৯ কোটি ৫৬ লাখের মতো বই।
এবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জন হয়েছে। এ কারণে পাঠ্যবই ছাপার কাজ দেরিতে শুরু হয়। আবার দরপত্র, অনুমোদন, চুক্তির মতো কাজগুলোতেও দেরি হয়েছে। এখন আবার মুদ্রণকারীদের পক্ষ থেকে কাগজ ও আর্ট কার্ডের সংকট, পর্যাপ্ত বাইন্ডার না থাকা, ব্যাংকঋণ পেতে অসুবিধাসহ কিছু কিছু অসুবিধার কথা বলা হচ্ছে। শিক্ষা বিভাগ ও মুদ্রণকারী উভয় পক্ষের কারণে এবার শিক্ষার্থীদের বই পেতে দেরি হচ্ছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত বই দেওয়ার জন্য তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মুদ্রণকারীরা যেসব সমস্যার কথা বলছেন, সেগুলো শিক্ষা উপদেষ্টা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের উদ্যোগে তাঁরা সমাধানের চেষ্টা করছেন। তাঁরা আশা করছেন, এ মাসের মধ্যে প্রাথমিকের এবং দশম শ্রেণির সব বই দিতে পারবেন। আর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বইও আগামী মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে দেওয়া যাবে।
ধাপে ধাপে বই
ঢাকার চারটি বিদ্যালয় গতকাল সরেজমিনে ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে একটি বিদ্যালয় ইস্কাটনের প্রভাতী উচ্চ বিদ্যানিকেতন। সেখানকার একজন শিক্ষক জানালেন, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সব বই এসেছে। চতুর্থ শ্রেণির ছয়টি বইয়ের মধ্যে তিনটি ও পঞ্চম শ্রেণির চারটি পাওয়া গেছে। মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির তিনটি বই পেলেও সপ্তম শ্রেণির একটি বইও পাওয়া যায়নি। অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির জন্য তিনটি বই এসেছে। এসব বই পেয়েছেন তিন দফায়।
বিদ্যালয়টির তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের সহকারী শিক্ষক সৈয়দ আবেদ আলী বলেন, আইসিটি বই এখনো পাননি। আগের অভিজ্ঞতা ও ওয়েবসাইট থেকে দেখে পড়াচ্ছেন।
ইংরেজি ভার্সনের বিদ্যালয় বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে গিয়ে জানা গেল, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই বৃহস্পতিবার এসেছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই এখনো পাওয়া যায়নি।
মতিঝিলের আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এই বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব বই বিতরণ করা হয়েছে। আর ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণির তিনটি করে বই পাওয়া গেছে। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির জন্য কোনো বই হাতে পাননি।
ঠিকঠাক ক্লাস হচ্ছে না, উপস্থিতিও কম
চট্টগ্রাম নগরের নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কোনো বই পায়নি। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে তিনটি করে বই। তবে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পেয়েছে আরেকটু বেশি, সাতটি করে।
একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেছেন, বই না থাকায় ঠিকঠাক ক্লাস হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম খীসা প্রথম আলোকে জানান, চট্টগ্রাম জেলায় বইয়ের চাহিদা ১ কোটি ৭৪ লাখ। গতকাল দুপুর পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৩৬ লাখ বই। অন্যদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আবদুর রহমান জানান, এ বছর চট্টগ্রাম জেলায় প্রাথমিকে বইয়ের চাহিদা ৪০ লাখ ৩৪ হাজার ১৯৬টি। গতকাল পর্যন্ত পাওয়া গেছে ২০ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮২টি। প্রাক্-প্রাথমিকে বইয়ের চাহিদা ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮২টি, পাওয়া গেছে ৯৫ হাজার ৭৩১টি।
দিনাজপুর সদরের উত্তর গোসাইপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী জানাল, ১১টি বইয়ের মধ্যে সে ৩টি বই পেয়েছে।
মেহেরপুরের কাথুলী ইউনিয়নের গাড়াবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখনো সব শ্রেণির পাঠ্যবই পায়নি।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের বেলঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুত্তালিব মৃধা জানালেন, তাঁরা অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে ক্লাস নিচ্ছেন। বোর্ডে লিখে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে যতটুকু পাচ্ছে তুলে নিচ্ছে।
রাঙামাটি সদর উপজেলার সুরবালা স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক অরুণ কান্তি চাকমা বলেন, এখন পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিনটি, অষ্টম শ্রেণির দুটি ও নবম শ্রেণির জন্য আটটি বই পেয়েছেন। বই পাওয়া যাচ্ছে ধাপে ধাপে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কাকিয়াছড়া চা-বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই এখনো পায়নি। তবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ৯০ শতাংশ বই পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যুথিকা দেবী বলেন, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনো বই না পাওয়ায় পুরোনো বই দিয়ে পড়াচ্ছেন। কিন্তু বই না দেওয়ায় উপস্থিত কম। নতুন বই হাতে পেলে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ থাকে।
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, প্রতিনিধি, দিনাজপুর, মেহেরপুর, জামালপুর, রাঙামাটি, পটিয়া, লোহাগাড়া ও শ্রীমঙ্গল]