ভারতে ২০২২ সালে চালু নতুন পাঠ্যক্রম, ৫ ‘ই’র ঘোষণা মোদির
ভারতে চালু হতে যাচ্ছে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি বা ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি (এনইপি)। এ কথা জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ২০২২ সালের মধ্যে স্কুলগুলো জাতীয় শিক্ষানীতির নতুন পাঠ্যক্রম গ্রহণ শুরু করবে। সিলেবাস কমাবে এবং শিক্ষাকে মজাদার ও সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক করে তুলবে।
গতকাল শুক্রবার এ ঘোষণা দেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনলাইনে যোগ দিয়ে শিক্ষা নিয়ে এক সম্মেলনে তিনি বলেন, নতুন শিক্ষানীতি সিলেবাস কমাবে। শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাক্রম হবে আনন্দদায়ক।
ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত জাতীয় শিক্ষা সংক্রান্ত ‘একবিংশ শতকের স্কুল শিক্ষা’ শীর্ষক সেমিনারে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘২০২২ সালের মধ্যে আমাদের শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন পাঠ্যক্রমের দিকে পা বাড়াবে। এটি ভবিষ্যতের প্রস্তুতি এবং বৈজ্ঞানিক পাঠ্যক্রম হবে। ভবিষ্যতে সমালোচনামূলক ভাবনা, সৃজনশীলতা, যোগাযোগ, কৌতূহলসহ নতুন নতুন দক্ষতা বাড়াবে শিক্ষার্থী। এ শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন হবে ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের অন্যতম অর্জন।’
শিশুদের নতুন ধরনের শিক্ষার জন্য নরেন্দ্র মোদি ৫ ‘ই’ সূত্রের কথা বলেছেন। এই ৫ ‘ই’ হলো Engage, explore, experience, express ও excel। এর প্রশংসা করে তিনি বলেন, এটি শিশুদের প্রতি অনেক বেশি মনোনিবেশ করে, মজা, আবিষ্কার ও ক্রিয়াকলাপের ভিত্তিতে শিক্ষার ওপর জোর দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার্থীদের কাঁধে ব্যাগ ও বোর্ড পরীক্ষার বোঝা চাপছে। আর শৈশব-কৈশোরের সেই অসহ্য চাপ থেকে মুক্তি দেবে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি।
মোদির দাবি, নতুন শিক্ষানীতিতে চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থার ধারণা দূরে সরিয়ে রেখে পড়ুয়াদের চিন্তাভাবনার ওপর বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, নয়া শিক্ষানীতিতে পড়াশোনার পরিবর্তে শেখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং পাঠ্যক্রম থেকে এগিয়ে গঠনমূলক চিন্তাভাবনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই নীতিতে প্রক্রিয়ার থেকে আবেগ, বাস্তবতা ও কর্মদক্ষতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
দেশকে শিক্ষণভিত্তিক শিক্ষার দিকে নিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ড্রপআউট (শিক্ষার্থী ঝরে পড়া) অনুপাতের পেছনে একটি বড় কারণ শিক্ষার্থীদের নিজস্ব বিষয় নির্বাচনের স্বাধীনতা নেই। এনইপি তা দেবে। এখন, শিক্ষার্থীদের বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে কঠোর সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে না এবং তারা যে বিষয় বেছে নিতে চায়, তাই পছন্দ করে নিতে পারবে।
এটি নম্বর এবং নম্বরপত্রভিত্তিক শিক্ষাকে শিক্ষণভিত্তিক করে তুলবে। স্কুলশিক্ষা হবে একুশ শতকের। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসির মানে নতুন ইন্ডিয়া, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন প্রয়োজন। তিনি বলেন, এ শিক্ষানীতি ভারতের শিক্ষার্থী মানসিক দক্ষতা বাড়াবে। বর্তমান শিক্ষাক্রমে নম্বরপত্র শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক যন্ত্রণা। সেটি থেকে মুক্তি মিলবে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষানীতি নিয়ে ১৫ লাখ চিঠি
নতুন শিক্ষানীতিমালা গ্রহণের আগে এর বাস্তবায়ন, সমস্যাসহ নানাবিধ বিষয়ে শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের কাছ থেকে প্রায় ১৫ লাখ চিঠি পেয়েছে ভারতের সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৪ থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে মতামত ও প্রতিক্রিয়া চেয়েছিল। প্রতিক্রিয়াগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৩৬৫টি চিঠি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি পরামর্শ উত্তর প্রদেশ (মোট ১১%) থেকে এসেছে। এরপরে রাজস্থান (১০.৭৬%), কর্ণাটক (১০.১৩%) ও তামিলনাড়ু (৯.০৮%) থেকে পরামর্শ, মতামত ও প্রতিক্রিয়া এসেছে।
বেশির ভাগ পরামর্শই ‘বিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রম এবং পাঠশালা: শিক্ষা সর্বদা সামগ্রিক, সংহত, উপভোগযোগ্য এবং আকর্ষণীয় হওয়া উচিত’ বিষয়ে এসেছিল। মোট ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৪৫৭ পরামর্শ, মতামত ও প্রতিক্রিয়া এসেছে এ বিষয়ে। এরপরে ‘ন্যায়সংগত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা: সবার জন্য শেখা’ থিমের ওপরে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৬৬টি পরামর্শ এসেছে। ‘শৈশবকালীন যত্ন ও শিক্ষা: শিক্ষার ভিত্তি’ শীর্ষক বিষয়েও ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৮১টি প্রতিক্রিয়া ও পরামর্শ এসেছিল।
বেশির ভাগ বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক পরামর্শ, মতামত ও প্রতিক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। সব মিলিয়ে ১১ লাখ ৬০ হাজার ৯২৪টি বেসরকারি স্কুল এবং ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫১৭টি সরকারি স্কুল প্রতিক্রিয়া, পরামর্শ ও মতামত জানিয়েছে।
অধ্যক্ষরা শিক্ষকদের চেয়ে কম পরামর্শ দিয়েছেন। তথ্যে দেখা গেছে যে ১৪ লাখ ৯ হাজার ৮৪৩ জন শিক্ষক এবং ১ লাখ ১১ হাজার ৯৭১ জন অধ্যক্ষ এতে অংশ নিয়ে ছিলেন।
কেরালা থেকে ১১ হাজার প্রতিক্রিয়া এসেছে। ভারতে কেরালার সাক্ষরতার হারও সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এনইপি সম্পর্কে সচেতনতা সেই রাজ্যে খুব একটা নেই বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
যদিও নরেন্দ্র মোদি সরকারের নতুন শিক্ষা নীতি নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা চলছে। আপত্তি উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকেও। অভিযোগ উঠেছে এই শিক্ষানীতিতে জোর করে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্য চাইছে আঞ্চলিক ভাষার মূল্যায়ন হোক।
দীর্ঘ ৩৪ বছর পর শিক্ষানীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অসংখ্য মানুষের মত নেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন মোদি। দেশজুড়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনার পরই নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষানীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ একেবারে ন্যূনতম রাখা উচিত। সেই প্রক্রিয়ায় যত বেশি শিক্ষক, অভিভাবক ও পড়ুয়া যুক্ত হবেন, তা তত বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।’
তথ্যসূত্র: এনডিটিভি ও হিন্দুস্তান টাইমস