পোকামাকড় ভালোবেসে মেডিকেল ছেড়ে কেমব্রিজে ড্যানিয়েল
পরিবারের আশা ও চাওয়া ছিল ছেলে উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মেডিকেলে পড়ে চিকিৎসক হবেন। কিন্তু ছেলের মনে ছিল অন্য কিছু। জীববিজ্ঞান পড়ার সময়ে তিনি কখনো পড়তে মজা পেতেন না ও আগ্রহ খুব একটা ছিল না। তাঁর আগ্রহ বেশি ছিল পোকামাকাড়ের জীবন ও বৈচিত্র্য নিয়ে। পরিবারের চাওয়ার চেয়ে নিজের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এখন পড়াশোনা করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ন্যাচারাল সায়েন্স’ বিভাগে। আর মেডিকেল ছেড়ে ড্যানিয়েল লিম ইউ হিয়ানের পোকামাকড় নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘টুডে অনলাইন’। ড্যানিয়েল লিম ইউ হিয়ানের ক্যারিয়ার বেছে নেওয়া এবং মেডিকেলে না পড়ে কেন কেমব্রিজে ‘ন্যাচারাল সায়েন্স’ পড়ছেন, তার বিস্তারিত আছে ওই প্রতিবেদনে।
ড্যানিয়েল লিম ইউ হিয়ান বলেন, ‘আমার ভালো লাগার শুরুটা হয়েছিল ক্লাসে জীববৈচিত্র্য নিয়ে এক প্রদর্শনীর সময়ে। মুগ্ধ হয়ে আমি প্রজাপতি, ঘাসফড়িংদের জীবন দেখছিলাম। তাদের বিচিত্র রং, গঠন, খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া সব টানছিল আমাকে। আমার মনে হচ্ছিল, এদের নিয়ে আরও জানার আছে।’
গত অক্টোবরে কেমব্রিজে তিন বছরের ন্যাচারাল সায়েন্সের ফার্স্ট টার্মের পড়া শুরু করেছেন সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থী ড্যানিয়েল লিম ইউ হিয়ান। এই সময়ে তাঁর অনেক বন্ধু মেডিকেলে পড়া শুরু করেছেন। কিন্তু ভালো না লাগায় মেডিকেলে না পড়ে তিনি জীববৈচিত্র্য ও পোকামাকড় নিয়ে পড়তে চলে গেছেন যুক্তরাজ্যে। জীববিজ্ঞান খুব একটা ভালো না লাগলেও মা–বাবার চাওয়া ছিল মেডিকেলে পড়ে ভবিষ্যতে ভালো চাকরি–বাকরি ও ক্যারিয়ার গড়ে জীবন এগিয়ে নেবেন। কিন্তু জীববিজ্ঞান পড়ার সময় তিনি কখনো এ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ অনুভব করতেন না।
কেমব্রিজের শিক্ষার্থী ড্যানিয়েল লিম ইউ হিয়ান তাঁর পোকামাকড় নিয়ে পড়াশোনা শুরুর কথা বলছিলেন, ‘আমি যখন ল্যাবে মাইক্রোস্কোপের তলায় পোকা দেখছি তখন আমার অনেক বন্ধুই মেডিসিনে ডিগ্রি নিচ্ছে। জীববিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় পরিবার থেকে মেডিকেলে পড়াশোনা করার জন্য চাপ ছিল। কিন্তু জীববিজ্ঞান পড়ার সময় কখনো মানবদেহের প্রতি আগ্রহ অনুভব করিনি। তার চেয়ে বেশি পোকামাকাড়ের বৈচিত্র্য আমাকে টেনেছে। আমি আমার স্বপ্নের পেছনে ছুটছি।’
১৭ বছর বয়সে ক্লাসে জীববৈচিত্র্য নিয়ে প্রদর্শনীর সময়ে প্রজাপতি, ঘাসফড়িংদের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয় ড্যানিয়েল লিম ইউ হিয়ানের। এরপর থেকে ড্যানিয়েল সিঙ্গাপুরের বাগানগুলোতে ঘুরতেন আর পোকামাকড়দের জীবন পর্যবেক্ষণ করতেন। ড্যানিয়েল বলেন, ‘আমি আমার চারপাশের পরিবেশের মাঝেই মিশে গিয়েছিলাম। পাতায় মোড়ানো পিঁপড়ার বাসা আমি ঘরে নিয়ে এসেছিলাম তাদের জীবন প্রক্রিয়া বোঝার জন্য। পোকামাকড়ের মাধ্যমে পরাগায়ন দেখতে রাতভর বাগানে জেগে থাকতাম।’ ড্যানিয়েল শামুক বা ঘাসফড়িংদের নামও দিতেন। তাঁর এমন কাণ্ড দেখে তাঁর বন্ধুরা ভাবতে শুরু করে সে হয়তো কিছুটা অবসাদে ভুগছে।
ড্যানিয়েল হিয়ান বলেন, ‘একটি ঘটনা আমার খুব মনে আছে। আমার বাড়ির কাছে একদিন লাল শাপলা দেখতে পেলাম। আমি ফুলটি হাতের তালুতে ধরেছিলাম। সেই অনুভূতি এখনো আমাকে নাড়া দিয়ে বেড়ায়।’
ড্যানিয়েল লিম ইউ হিয়ান সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ডা. এনজি নাগান কির কাছ থেকে। ওই শিক্ষকের সঙ্গে ড্যানিয়েলের দেখা হয় ইন্টারন্যাশনাল বায়োলজি অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়। ওই শিক্ষকই তাকে পতঙ্গের শ্রেণিবিন্যাস শেখান। এসব বিষয় ড্যানিয়েল স্কুলে শেখেননি।
এনজি নাগান তার বিদেশের দুঃসাহসিক গল্পগুলো ড্যানিয়েল হিয়ানদের সঙ্গে শেয়ার করতেন। তিনি পুরো দিন নতুন প্রজাতির কাঁকড়ার সন্ধানে কীভাবে কাটিয়েছিলেন, সে বর্ণনাও শিক্ষার্থীদের শুনিয়েছেন।
ড্যানিয়েল লিম হিয়ান বলেন, ‘আমার যা গ্রেড ছিল তাতে মেডিকেলে সহজেই পড়তে পারতাম। কিন্তু ডা. এনজি নাগান আমাকে তাঁর সব অভিজ্ঞতা বলেছিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রজাতির পোকা সম্পর্কে আমাকে বলতেন। আমাকে কখনো বলেননি তুমি পারবে না।’ বরং তিনিই আমাকে বলেছিলেন, পোকামাকড়ের প্রতি আগ্রহ শুধু একটি শখ না, পেশাও হতে পারে।
মেডিকেলে পড়ার আগ্রহ কমে যাওয়ার গল্প শুনিয়ে ড্যানিয়েল লিম হিয়ান বলেন, ‘মেডিকেলের সিনিয়র শিক্ষার্থীদের কাছে গল্প শুনেও আমি মেডিকেলে পড়ার আগ্রহ হারাই।’ তারা আমাকে বলেছিলেন, সূর্যোদয়ের পরই আমরা কর্মস্থলে গিয়ে গভীর রাতে বাড়িতে ফিরি। এ কথা শোনার পর মেডিসিন নিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
কলেজের এক শিক্ষকের নির্দেশনায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন ড্যানিয়েল হিয়ান। সুযোগও পেয়ে যান। এরপর ড্যানিয়েল ‘লি কং চিয়ান ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম’–এর পতঙ্গবিষয়ক কিউরেটর ড. হুয়াং ওয়েই সংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানে ড্যানিয়েলের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করে দেন হুয়াং ওয়েই সং। একজন গবেষকের অধীন বর্তমানে মান্দাই পার্কে বিভিন্ন পোকার জীবন নিয়ে জরিপ করছেন ড্যানিয়েল। ড্যানিয়েলকে তাঁর বিভাগ বাসায় বসে পোকা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি মাইক্রোস্কোপও দিয়েছে।
ড্যানিয়েল এখন পোকামাকড়ের নমুনা এবং অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের তথ্য সংগ্রহের জন্য ডেটা সায়েন্স ব্যবহার করছেন আর কাজ শিখছেন। কীটপতঙ্গ নিয়ে পড়াশোনায় সম্ভাবনা সম্পর্কে ড্যানিয়েলের মা–বাবা সংশয়ী ছিলেন। তবে দিন দিন তাঁদের সংশয় কেটে যাচ্ছে। তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পেশাজীবী। কিন্তু ড্যানিয়েল হিয়ানের মিনি ল্যাব এবং পোকামাকড়ের নমুনার জারের বয়ামগুলো দেখে তাঁদের কৌতূহল ছড়িয়ে পড়ে। তার কাজের সংস্পর্শে আসার পরে ড্যানিয়েলের মা–বাবা বুঝতে পেরেছেন যে এটি তার সত্যিকারের আগ্রহের জায়গা। এটি শখের পাশাপাশি নিরপেক্ষ যদি ভাবা হয়, তবে ক্যারিয়ারও আছে, তা–ও বুঝতে পেরেছেন ড্যানিয়েল হিয়ানের মা–বাবা।
ড্যানিয়েল বলেন, আমি শুধু নামডাক শুনে কেমব্রিজে আসিনি। আমি এখানে না এলে আমার মতো একই ভাবনার কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে পারতাম না। আমি এখন জানি, আমি এমন কিছু নিয়ে কাজ করছি যা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে, পৃথিবীকে সবুজ রাখে। আমি এখানকার শিক্ষা নিয়ে সিঙ্গাপুরে ফিরে আমার নিজের দেশকেও সুন্দর ও প্রাণবৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলতে চাই। প্রতিটি মাঠ একটি অজানা সমাজ, প্রতিটি পুকুর একটি অজানা পৃথিবী, আর মানুষের পৃথিবীকে সুন্দর করতে হলে সেই অজানা পৃথিবীর অজানা সমাজ নিয়ে জানতে ও তাদের রক্ষা করতে হবে বলেও জানান ড্যানিয়েল।