কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূর হোক শিক্ষক-প্রশাসন দ্বন্দ্ব
করোনা অতিমারিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম অনেকাংশে থেমে গেলেও থেমে নেই চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতির চাকা। ইংরেজ যাজক ও লেখক চার্লস ক্যালেব কল্টন বলেছিলেন, দুর্নীতি অনেকটা তুষারগোলকের মতো। একবার তা গড়াতে শুরু করলে আকারে শুধু বাড়তেই থাকে, কমে না। সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকাণ্ড এ কথা মনে করিয়ে দেয়।
কুবি প্রশাসন গণমাধ্যমে তথ্য দেওয়ার ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে ওই বিভাগের শিক্ষক কাজী এম আনিছুল ইসলামের পদোন্নতি বাতিল করেছে।
গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবষের্র ভর্তি পরীক্ষায় এক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ না করেও মেধাতালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করেন। এ ঘটনায় গঠিত প্রথম তদন্ত কমিটি পরীক্ষা কমিটির দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পায় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু কুবি প্রশাসন ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গ্রাহ্য না করে নীরব ভূমিকা পালন করে। এরপর এ ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ পেতে শুরু করলে গণমাধ্যমে কে তথ্য দিল, তা চিহ্নিত করতে ‘উচ্চতর তদন্ত কমিটি’ নামে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। উচ্চতর কমিটি শুধু তথ্যদাতাকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু কাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এমন ভুল হলো, এই প্রতিবেদন তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
আমাদের দেশে নানা সময় নানা প্রসঙ্গে সময়ের চাহিদায় একেকটি আইন প্রণীত হয়। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারী ব্যক্তিকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে বিধান প্রণয়নকল্পে ২০১১ সালে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন প্রণীত হয়। এ আইন অনুযায়ী, কোনো তথ্য প্রকাশকারী ধারা ৪–এর উপধারা ১–এর অধীনে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো সঠিক তথ্য প্রকাশ করলে ওই ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া তাঁর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। সঠিক তথ্য প্রকাশের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা বা কোনো বিভাগীয় মামলা করা যাবে না। মোটকথা, তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, যা তথ্য প্রকাশকারীর মানসিক, আর্থিক বা সামাজিক সুনামের জন্য ক্ষতিকর হয়।
আপাতদৃষ্টে এটিকে সর্বসাধারণের ত্রাণকর্তা আইন বলে মনে হলেও এখানে কিছু কিন্তু রয়ে গেছে। তথ্য প্রকাশকারী ব্যক্তিকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায় জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য দিতে হবে। ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের’ কাছে সঠিক তথ্য দিলে তারা সে ব্যাপারে কতটুকু পদক্ষেপ নেবে, তা কুবির ‘উচ্চতর তদন্ত কমিটির’ পদক্ষেপ থেকে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। তাই নতুন আইন প্রণয়নের চেয়ে বরং প্রণীত আইনের লুপহোলগুলো সংশোধন করে, তা জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহারপযোগী করে তোলা প্রয়োজন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ২০১৯ সালে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সাংবাদিকতা বিভাগ খুলে পাপ করেছি।’ এ কথায় সমর্থন জানিয়েই বোধ হয় কুবি প্রশাসন বিভাগটির প্রতি উদ্দেশ্যমূলক বিদ্বেষ প্রদর্শন করছে। এক দিকে গণমাধ্যমে তথ্য প্রকাশের দায়ে মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যা স্বাধীন গণমাধ্যম পরিপন্থী। আরেক দিকে অভিজ্ঞতা সনদে ‘টু রেজিস্ট্রারের’ বদলে ‘টু হুম ইট মে কনসার্ন’ লেখা থাকায় কাজী আনিছের পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে। উপাচার্য নিজে বলেছেন, কাজী আনিছুলের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তা সত্ত্বেও সনদের ঠুনকো একটি ত্রুটি দেখিয়ে এক সিন্ডিকেটে পদোন্নতি দিয়ে পরের সিন্ডিকেটে তা স্থগিত করা হয়েছে। এই যে দুজন তরুণ শিক্ষক ভালো ফলাফল করে, জ্ঞানান্বেষণের পাশাপাশি কুবিকে গড়ে তুলতে করোনাকালে সৃজনশীল সব কাজ করে যাচ্ছেন, এটাই কি তাঁদের প্রাপ্য? বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সমাজের দাসত্ব মোচনের ঐতিহাসিক দায় নিয়েছে, সেখানে এই দুই শিক্ষক অভ্যন্তরীণ কূটচালের শিকার হচ্ছেন না তো? বাঁশঝাড়ে সবচেয়ে সুন্দর আর সোজা বাঁশটি সবার আগে কাটা পড়ে। একটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের জন্য ওখানকার দুই শিক্ষককে আমলাতান্ত্রিক ঝুটঝামেলায় সবিশেষ ব্যস্ত রেখে ‘টাইট’ দেওয়ার অপকৌশল নয় তো?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর শিক্ষকদের মধ্যকার সম্পর্কের এমন টানাপোড়েন নিয়ে যখন বারবার সংবাদ হতেই থাকে, তখন শিক্ষার্থীদের মনে তা কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে? শিক্ষার্থীরা তাঁদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় যেখানে কাটাবে, গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যেখান থেকে পাবে, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ে তোলা ভীষণ জরুরি। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক ও প্রশাসনের অন্তঃকোন্দলের কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব, জ্ঞানচর্চার সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করুক, এটাই প্রত্যাশা।
*লেখক: রাজীব নন্দী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এবং
ফারজানা তাসনিম, প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।