স্কুলের শিশুরা রেস্তোরাঁর স্মোকিং জোনের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিতে

প্রচণ্ড গরমে ঠান্ডা ফলের জুস খাওয়ার বায়না ধরেছে রাজধানীর তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। মা ছেলের আবদারে সাড়া দিয়ে ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে স্কুল শেষে তাকে নিয়ে বসে। কিছুক্ষণ পরে রেস্টুরেন্টের সঙ্গে থাকা স্মোকিং জোনের দরজা খুলতেই একগাদা সিগারেটের ধোঁয়া এসে ঢোকে শিশুটির নাকে–মুখে। স্বাভাবিক হতেই পারছিল না শিশুটি। অথচ এ নিয়ে রেস্টুরেন্টের কর্মচারী বা ম্যানেজারের কোনো খেয়াল নেই। পরে জুস না খেয়েই ফিরে যায় শিশুটি। এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে আজকাল বিভিন্ন খাবারের দোকানে। আলাদা স্মোকিং জোন থেকে আসা ধোঁয়ার বিষয়ে যেমন কোনো সচেতনতা নেই, তেমনি নেই কোনো তদারকিও। অভিযোগ করেও সুরাহা পাচ্ছেন না অভিভাবকেরা।

এ বিষয়ে রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা আকমল হোসেন বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে বসে ছিলেন মাসখানেক আগে। সঙ্গে ছিল স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে। স্কুলের শিক্ষার্থী শিশুদের আবদার ছিল আইসক্রিম খাবে। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় রেস্টুরেন্টে তাঁরা বসে ছিলেন স্মোকিং জোনে। আশপাশেও ফাঁকা ছিল তখন। যেই আইসক্রিম খাওয়া শুরু করল, তখন দুজন এসে স্মোকিং জোনে সিগারেট খেতে শুরু করে। বাধা দেওয়ায় উল্টো কথা শুনতে হয়, আপনারা কেন স্মোকিং জোনে এসে বসেছেন। এখানে সিগারেট খাওয়াই হয়। এতে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। ভালো না লাগলে চলে যান। পরে বাধ্য হয়ে সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যেই দুই শিশু আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে। এই ঘটনার পর আর স্মোকিং জোন থাকা কোনো রেস্টুরেন্টে যান না আকমল হোসেন।

পরোক্ষ ধূমপানে শিশুর যত ক্ষতি

শিশু চিকিৎসক ডা. আবু সাঈদ তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, শিশুরা এমনিতে দ্রুত শ্বাস নেয়, তা ছাড়া তাদের শ্বাসতন্ত্রও অপরিণত। তাই সিগারেটের ধোঁয়া সহজেই শিশুদের শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করে সমূহ ক্ষতি করে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে শিশুর নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি ইত্যাদি রোগ হয়।

পরোক্ষ ধূমপানের শিকার মানুষের শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে শিশু অল্পতেই রোগাক্রান্ত হয়। যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হাজার হাজার শিশু বিভিন্ন রোগে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ ছাড়া মধ্যকর্ণের প্রদাহ, বধিরতা, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, ঝিমুনি, অস্থিরতাও হতে পারে। শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় সিগারেটের ধোঁয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু গণিত ও যুক্তিবিদ্যায় কম পারদর্শী, তাদের বেশির ভাগেরই মা-বাবা ধূমপায়ী। এরা শিক্ষক ও সহপাঠীর সঙ্গে সঠিক আচরণ করতেও শেখে না।

আরও পড়ুন

গর্ভাবস্থায় মা ধূমপান করলে সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কারণ, গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে যে রক্ত বাহিত হয়, তার অক্সিজেন ধারণক্ষমতা কমিয়ে দেয় তামাকের কার্বন মনোক্সাইড। নিকোটিন গর্ভফুলের রক্ত সরবরাহ হ্রাস করে। ফলে মায়ের শরীর থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে যেতে পারে না, তাই শিশুর বৃদ্ধিও ব্যাহত হয়। এ ছাড়া ধূমপানের কারণে গর্ভপাত কিংবা অপরিণত শিশু জন্মাতে পারে। এই অপরিণত শিশুরা আবার সংক্রমণ বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, পরিবারে বাবা, বড় ভাই বা অন্য কেউ ধূমপান করলে শিশুরা সহজেই আকৃষ্ট হয়। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে সময় এসেছে সচেতন হওয়ার। প্রকাশ্য স্থানে (পাবলিক প্লেসে) এবং বাড়িতে—সব জায়গায়ই ধূমপান বর্জন করুন।

৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে নিকোটিন

বাংলাদেশের শিশুদের বিরাট অংশ ধূমপানের বিষক্রিয়ার শিকার। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আশপাশ এলাকার ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিন আছে। পরোক্ষ ধূমপান নিকোটিন উপস্থিতির কারণ।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার ছয়টি ও সাভার এলাকার ছয়টি প্রাথমিক স্কুলের ৪৭৯টি শিশুর লালা পরীক্ষায় ক্ষতিকর নিকোটিন পাওয়া গেছে। গবেষণাটি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে। ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার: ঢাকা, বাংলাদেশে একটি জরিপ’ (সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন: আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ) শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিশুদের ওপর পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ এবং লিডস সিটি কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে এ গবেষণা করেছে। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসায় বাবা, বড় ভাই বা অন্য কেউ ধূমপান করে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু। রাস্তায়, বাসে, দোকানে, হোটেলে অনেকে সিগারেট খান, সেই ধোঁয়া যায় শিশুর শরীরে। এই পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব নিয়েই আমাদের গবেষণা।’

গবেষণা ফলাফলকে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক বলেছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি চিকিৎসক অধ্যাপক আলী হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির অন্যতম প্রধান কারণ এই পরোক্ষ ধূমপান। বাবা, বড় ভাই বা পথচারী যে ধোঁয়া ছাড়ছে, তার শিকার হচ্ছে শিশুরা। ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই বিপদ থেকে শিশুদের রক্ষার উপায় নেই।’

ধূমপায়ীরা যে ধোঁয়া ছাড়ে, তা নিশ্বাসের সঙ্গে অন্যের শরীরে প্রবেশ করে। এটাই পরোক্ষ ধূমপান। গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪০ শতাংশ শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। বহু গবেষণায় শিশু স্বাস্থ্যে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে। একই পরিবেশে পরোক্ষ ধূমপানে স্বাস্থ্যঝুঁকি বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের বেশি, কারণ বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেশি। আশপাশে কেউ ধূমপান করলে তাতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা শিশুদের তুলনামূলকভাবে কম।

গবেষণায় ৪৩ শতাংশ শিশু (২০৮ জন) বলেছে, তার পরিবারে কমপক্ষে একজন ধূমপান করে। ২১ শতাংশ শিশু (১০০ জন) বলেছে, তার পরিবারে সদস্যদের ও অতিথিদের ধূমপান নিষেধ। ৮৭ শতাংশ শিশু (৪১৯ জন) বলেছে, তারা সম্প্রতি জনপরিসরে (পাবলিক প্লেস) পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে আছে দোকানে, রাস্তায় পরোক্ষ ধূমপান করা।

আইনে যা আছে আর যা করা দরকার

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫  অনুযায়ী চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেস এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে মাত্র কয়েকটি স্থান (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, গ্রন্থাগার, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র ও থিয়েটার হলের অভ্যন্তরে, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ এক কক্ষবিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, শিশু পার্ক, খেলাধুলা ও অনুশীলনের জন্য নির্ধারিত আচ্ছাদিত স্থান এবং এক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহন) ব্যতীত বেশির ভাগ পাবলিক প্লেস এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে (ট্রেন, স্টিমার ইত্যাদি) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ‘ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন’ রাখার সুযোগ রয়েছে। ফলে অধূমপায়ীদের পাশাপাশি এসব স্থানে সেবা প্রদান করতে গিয়ে সেবাকর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। কাজেই বিদ্যমান আইনটি কোনোভাবেই পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

এফসিটিসি আর্টিকেল ৮–এর গাইডলাইন এবং অসংখ্য গবেষণা দ্বারাও এটা স্বীকৃত যে, আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশপাশের স্থানসমূহ কখনোই ধোঁয়ামুক্ত হয় না।

আরও পড়ুন

বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা রাখার সুযোগ থাকায় শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে, যেখানে সব পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোলের (এফসিটিসি) ধারা ৮ ও এ–সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় ‘পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।  

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত, ওয়েবসাইটে প্রকাশ, অংশীজনের মতামত গ্রহণ এবং আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য ক্যাবিনেট ডিভিশনে প্রেরণ করেছে। খসড়া আইনে সব পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখার বিধান (ধারা ৭ ও ধারা ৭ক) বিলুপ্ত করা হয়েছে। ‘যেকোনো ধরনের রেস্টুরেন্ট, খাবারের দোকান, কফি হাউস, চায়ের দোকান ও প্রাঙ্গণ’সহ সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত সব ধরনের পাবলিক প্লেস এবং সব ‘যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক’ গণপরিবহনে ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ‘প্রাঙ্গণ’ হিসেবে পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত সব ভবনের বারান্দা, প্রবেশ ও বহির্গমন গেট এবং ভবন সংস্কার আচ্ছাদিত-অনাচ্ছাদিত স্থান, সামনে-পেছনের মাঠ ও বাগানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ধূমপানমুক্ত এলাকায় ধূমপানের জরিমানা তিন শ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে এক হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।

গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের বলেন, শিশুদের সুরক্ষায় ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধসহ খসড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাস করতে হবে।

আরও পড়ুন