গণিত পরীক্ষার সময় আগেও ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বেধেছে
বেথলেহেমের পূর্বে ফিলিস্তিনের শহর বেইত সাহোরের আকাশ গত শনিবার সকালে পরিষ্কার ছিল। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে শিক্ষার্থীরা স্কুলের ফটকের বাইরে মা-বাবাকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করছিল। সবাই বুকে হাত দিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে প্রথম ক্লাসে ঢুকে পড়ে।
সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে প্রথম ক্লাস শুরু হয়। ৮টা ২০ মিনিটের দিকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। এর পরপরই ফোনে শিক্ষকেরা নিশ্চিত হয়ে যান, ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার শব্দ এটি। এর মধ্যেই সাড়ে আটটায় স্কুলের ঘণ্টা বাজে। যথারীতি শুরু হয় দ্বিতীয় ক্লাস।
ক্লাসে শিক্ষার্থীরা কেউ অঙ্কের সমাধান করছিল, কেউবা ইংরেজি বই পড়ছিল। শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বার্তা পেয়ে তা সবাইকে জানাচ্ছিলেন শিক্ষকেরা। ততক্ষণে এসব সংবাদ গণমাধ্যমে পৌঁছায়নি। বিষয়টি জরুরি ছিল, কিন্তু কারও মনে কোনো ভয় ছিল না। কারণ, এ ধরনের ঘটনা ফিলিস্তিনে নতুন কিছু নয়।
সকাল পৌনে নয়টায় স্কুল প্রশাসন একটি অফিশিয়াল নোটিশ দেয়। নোটিশে বলা হয়, নিরাপত্তার জন্য অভিভাবকেরা যেন দ্রুত স্কুল থেকে তাঁদের সন্তানদের বাড়িতে নিয়ে যায়। এ খবর মুহূর্তেই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিচে হলরুমে অভিভাবকদের অপেক্ষা করতে থাকে। এ সময় পাশের দিগন্ত থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেলে সবার ভেতর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকেরা দ্রুত সবাইকে চলে যেতে বলেন। তখনো অনেক শিক্ষার্থীই জানে না যে যুদ্ধ লেগে গেছে।
ওই দিন ছিল নবম শ্রেণির গণিত পরীক্ষা। পরীক্ষার মাঝেই গণিত শিক্ষক শিরিনের কাছে পৌঁছায় যুদ্ধ শুরুর খবর। শুরুতেই তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে এই ছোট ছোট শিশু যুদ্ধের ভেতর দিয়ে কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে। তিনি নিজেও ছোটবেলায় এই স্কুলে পড়েছেন। এখন তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে ৯ বছর বয়সী ইহাব চতুর্থ শ্রেণি ও ১১ বছর বয়সী মায়া ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই স্কুলের শিক্ষার্থী।
শিরিন যখন হাইস্কুলে পড়েন, তখন দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (গণ-অভ্যুত্থান, ২০০০-০৫) চলে। ২০০২ সালে তিনি মাধ্যমিক স্তরের (তাওজিহি) পরীক্ষা দেন। ফিলিস্তিনের হাইস্কুলের শেষ বছরটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারণ করে এমন একাধিক মানসম্মত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ব্যয় করেছিল। তাঁর পরীক্ষার সময় নেটিভিটি চার্চে ইসরায়েলি অবরোধ ছিল। সেখানে ২০০২ সালের ২ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি সৈন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন।
ওই বছর ইসরায়েলি বাহিনী যখন কারফিউ ঘোষণা করেছিল, সেদিনও শিরিন গণিত পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। শিরিনের মনে আছে, সেদিন সৈন্যরা পরীক্ষাকক্ষে গিয়ে ‘মামনুআ আল-তাজাওল’ বলে পরীক্ষায় বাধা দিয়েছিলেন। কাউকে নড়াচড়া করতে দেওয়া হয়নি।
শিরিন বলেন, ‘সেদিন বাইরে যা–ই ঘটুক না কেন, শিক্ষকেরা আমাদের পরীক্ষা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই কারফিউ চলাকালে বিশেষ অনুমতি নিয়ে একটি সরকারি গাড়ি শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। সেই বছর অনেক শিক্ষার্থী অবরোধের কারণে তাওজিহি পরীক্ষা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল।’
ইন্তিফাদা না হলে শিরিন পশ্চিম তীরের বিরজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মা–বাবা তাঁকে বেশি দূরে যেতে দিতে চাননি। চেয়েছিলেন মেয়ে বাড়ির কাছাকাছি থাকুক। তাই তিনি বিরজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি না হয়ে বেথলেহেম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। যুদ্ধ তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে। আর এবার তাঁর সন্তানেরা হয়তো প্রথমবারের মতো একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে।
গত শনিবার যুদ্ধের ঘটনা শুনে শিরিনের ছেলে ইহাব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সে ও তার বোন মায়া বিকট শব্দ শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তবে ইহাব আশা করেছে, এর মধ্য দিয়ে হয়তো ফিলিস্তিন স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু শিরিন ছেলেকে জানিয়েছেন, স্বাধীনতা এখনো অনেক দূরে।
মায়া বলেছে, ‘স্কুল থেকে এক দিনের ছুটি পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু অনেক উচ্চশব্দে সাইরেন ও বোমা বিস্ফোরণ হওয়ায় ভয় পেয়েছিলাম।’
এর আগে কোনো ধর্মঘট বা কারও হত্যার খবর পেয়ে ইহাব ও মায়াকে স্কুল থেকে বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। এবারই প্রথম তাদের যুদ্ধের কারণে স্কুল থেকে বাড়ি পাঠানো হলো। তারা বাড়ি থেকে ভিডিও কলে বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছে, আরও বিস্তারিত খবর জেনেছে। মায়া তার পড়াশোনার ওপর এই যুদ্ধের প্রভাবের কথা ভেবে বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ, স্কুল বন্ধ থাকলে সে পড়াশোনা করতে পারে না। সে বলেছে, ‘শিক্ষিত হয়ে জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে রক্ষা করতে পারি।’
শিরিনও তাঁর মেয়ের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, শিক্ষক হিসেবে কাজের মাধ্যমে তিনি এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করার আশা করেন, যা একটি শক্তিশালী ফিলিস্তিন গড়ে তুলতে পারে। এটিই হবে তাঁদের প্রতিরক্ষার পদ্ধতি।
করোনা মহামারির পর যুদ্ধের কারণে স্কুলটি প্রথমবারের মতো আবারও অনলাইনে পাঠদানের পরিকল্পনা করছে। এ কারণে শিরিন বেশ উদ্বিগ্ন। তাঁর ধারণা, এতে আবারও শিক্ষার্থীরা মূল ধারণা এবং প্রয়োজনীয় যোগাযোগের দক্ষতা থেকে বঞ্চিত হবে।
শিরিন বলেন, ‘আমি চাই আমার সন্তানেরা, আমার শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করুক। মানুষ সত্যিই ভয় পায়। আমরা বেথলেহেম ছাড়তে পারব না—আল-জিসর (অ্যালেনবি ব্রিজ) বন্ধ, বিমানবন্দর বন্ধ। সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।’
শিরিন আরও বলেন, এখানকার অর্থনীতি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। এ যুদ্ধের অর্থ হলো হাজারো পরিবার তাদের চাহিদা মেটাতে লড়াই করবে। মানুষ এর জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়।’
প্রথম ইন্তিফাদার কথা স্মরণ করে শিরিন বলেন, ‘আমি তিন বছর বয়সে যা ছিলাম, তার মধ্য দিয়েই বেঁচে আছি।’ নিজে বলতে পারেন না বলে তিনি ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের ‘ফিলিস্তিন’ কবিতার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘শান্তির জন্য সৃষ্ট ভূমিতে শান্তি, তবু জীবনে শান্তির দেখা মেলেনি।’
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত আজ মঙ্গলবার চতুর্থ দিনে গড়াল। গত শনিবার বিমান ও স্থলপথে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায় ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস। এর পর থেকে লড়াই চলছেই। হামাসের অতর্কিত হামলায় হকচকিত ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে। গতকাল সোমবার তারা গাজা উপত্যকায় অন্তত এক লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে। ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা বাড়িয়েছে এবং হামাস যোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে গাজায় খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। যুদ্ধে উভয় পক্ষের মৃত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৬০০-তে এসে দাঁড়িয়েছে।