গবেষণায় অনন্য কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি

কাউস্ট ক্যাম্পাস
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

সৌদি আরবের একমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। একে সংক্ষেপে কাউস্ট বলে। এটি গবেষণাধর্মী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৯ সালে সৌদি আরবসহ বিশ্ববাসীর জন্য বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্দেশ্যে কাউস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়।

কাউস্টের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা কিং আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আল-সউদ বলেছিলেন, ‘কাউস্ট হবে সৌদি আরব ও বিশ্বমানবতার ভবিষ্যতের শান্তি, আশা ও পুনর্গঠনের দিশারী।’

কাউস্টের গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তিনি ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি বন্ড হিসেবে বিনিয়োগ করেছেন। এখান থেকে কাউস্ট প্রতিবছর এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা গ্রহণ করে। এই মুনাফা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ব্যয় মেটানো হয়। বিনিয়োগের দিক দিয়ে বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কাউস্ট ষষ্ঠ।

পবিত্র মক্কা নগরী থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার উত্তরে লোহিত সাগরের পাড় ঘেঁষে এই বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এর আয়তন ৮ হাজার ৯০০ একর। মরুভূমিকে সবুজে পরিণত করে গড়ে উঠেছে এই বিশ্বমানের গবেষণার পাওয়ার হাউস। এই ক্যাম্পাসের মধ্যে আছে পূর্ণাঙ্গ আবাসনব্যবস্থা, হাসপাতাল, ডে-কেয়ার, বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য ইংরেজি মিডিয়াম (ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকালোরেট, IB) স্কুল (প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত), নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান, পোস্ট অফিস, ফায়ার সার্ভিস, তেলের পাম্পসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু। গবেষণার পাশাপাশি বিনোদনের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক সিনেমা হল, সি বিচ, রেস্তোরাঁ, দৃষ্টিনন্দন জলের ফোয়ারা, অত্যাধুনিক সুইমিংপুল, পার্ক, মিউজিয়াম, ব্যায়ামাগার ও খেলার মাঠ। কাউস্ট ক্যাম্পাসে বহিরাগত ব্যক্তিদের প্রবেশের অনুমতি নেই।

সমাবর্তন অনুষ্ঠান
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

খাদ্য, জ্বালানি, পানি ও পরিবেশ—গবেষণার এই চার স্তম্ভের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মানবকল্যাণের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালে ৪০০ জন স্নাতকোত্তর-পিএইচডি শিক্ষার্থী ও ৭০ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই বিদ্যাপীঠ। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ, ফ্রি আবাসন, মাসিক খাওয়াদাওয়ার খরচ ও স্বাস্থ্যবিমা। এ ছাড়া ডিপেনডেন্টদের জন্য আছে পার্টটাইম বা ফুলটাইম চাকরির সুযোগ।

শতভাগ আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১২৬টির বেশি দেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক মিলিয়ে ৭ হাজার ৫০০–এর বেশি গবেষক কর্মরত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকবল সৌদি আরব, ভারত ও চীনের। বাংলাদেশের মাত্র ৫–৬ জন গবেষক আছেন।

আবাসিক ভবন
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য রয়েছে সুপারকম্পিউটার, যা পৃথিবীর সর্বাধুনিক সুপারকম্পিউটারগুলোর মধ্যে একটি ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের ক্লিনরুম। এ ছাড়া অত্যাধুনিক গবেষণার যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের প্রায় অনেক বিষয়েই গবেষণা করা হয়। প্রতিনিয়ত চালু হচ্ছে আরও নতুন নতুন বিষয়। এখানকার ল্যাব ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে।

ক্যাম্পাসের ভেতরে রয়েছে ডে-কেয়ার ও বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য স্কুল
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

গবেষণার মান, সংখ্যা, সাইটেশন ও অন্যান্য মানদণ্ড বিবেচনা করে ২০১৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে ৫০০–এর মধ্যে চলে আসে। আর প্রতিষ্ঠার মাত্র ১১ বছর পরেই বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং নেচার ইনডেক্স অনুযায়ী ১১৯তম হয়, যা সৌদি আরবের মধ্যে প্রথম। ৫০ বছরের কম বয়সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাঙ্কিংয়ে কাউস্ট ষষ্ঠ (নেচার ইনডেক্স)।

ইউএস নিউজ অনুসারে, বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে কাউস্টের অবস্থান ৯৭তম। এ ছাড়া বিষয়ভিত্তিক র‍্যাঙ্কিংয়ে অভাবনীয় উন্নতি সাধন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেমিস্ট্রিতে ১০তম, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সে ১৬তম ও ন্যানোসায়েন্স অ্যান্ড ন্যানোটেকনোলজিতে ১৮তম।

২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে ল্যাব
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

কাউস্টের বর্তমান প্রেসিডেন্ট টনি চেন আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড থেকে পিএইচডি করেছেন। কাউস্টে প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে তিনি হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি শুধু প্রশাসকই নন, একজন কম্পুটেশনাল গণিতবিদও। তিনি ইমেজ প্রসেসিং, কম্পুটেশনাল ব্রেন ম্যাপিং, ফিজিক্যাল সার্কিট ডিজাইন ও কম্পিউটার ভিশন নিয়ে গবেষণা করেছেন। আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর দুই শতাধিক প্রকাশনা রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

কাউস্টের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট শি ছুন ফং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। কাউস্টে যোগ দেওয়ার আগে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

গ্রন্থাগারে আছে নিরিবিলি পড়ার জায়গা
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

ক্ল্যারিভেট অ্যানালিটিকস-২০২১ অনুযায়ী, কাউস্টে বর্তমানে ১৫ জন হাইলি সাইটেড অধ্যাপক আছেন।

কাউস্টে ভর্তি
এখানে শুধু স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ের শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। প্রতিবছর আগস্ট মাসে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ছবি: কাউস্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

শর্তাবলি
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে আইএলটিএসে কমপক্ষে ৬ দশমিক ৫ অথবা টোফেল স্কোর ৭৯ থাকতে হয়।

জিআরই থাকলে কিছু সুবিধা পাওয়া যায়, তবে বাধ্যতামূলক নয়। জিপিএ–৪–এর স্কেলে কমপক্ষে ৩ দশমিক ৭০ থাকতে হয়।

তিনটি রেকমেনডেশন লেটার, সিভি, স্নাতকের ট্রান্সক্রিপ্ট-সার্টিফিকেট ও স্টেটমেন্ট অব পারপাস দিতে হয়।

লেখক:

  • ড. শরৎ চন্দ্র বর্মণ: পোস্টডক ফেলো, কাউস্ট

  • ড. শুভ জিত দত্ত: স্টাফ সায়েন্টিস্ট, কাউস্ট