‘প্রত্যয়’ প্রত্যাহারের দাবি
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামীকাল থেকে কর্মবিরতি, বন্ধ ক্লাস-পরীক্ষা
সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিমকে’ বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এটি প্রত্যাহার দাবিতে আজ রোববার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কর্মবিরতি পালন করছেন। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দাবি আদায়ে কাল সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। আজ দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের মূল ফটকে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দিয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতির মোর্চা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও কাল থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন।
এত দিন কর্মবিরতিতে পরীক্ষা এর আওতার বাইরে ছিল। কিন্তু কাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাসহ দাপ্তরিক সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন শিক্ষকেরা।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের দাবি হলো তিনটি। এগুলো হলো প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি শুধু প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল। দাবি আদায়ে আজ পূর্ণদিবস কর্মবিরতির পাশাপাশি অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ।
ঢাবির সব ক্লাস বন্ধ থাকবে, সব পরীক্ষা বর্জন, অনুষদের ডিনরা তাঁদের কার্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন, কোনো বাছাই বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে না, ইনস্টিটিউটের পরিচালকেরা ইনস্টিটিউটের কার্যালয়, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখবেন, সন্ধ্যাকালীন ক্লাস বন্ধ থাকবে এবং প্রধান গ্রন্থাগারিক কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বন্ধ রাখবেনজিনাত হুদা, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক
শিক্ষকদের আন্দোলন
গত ১৩ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এর বিরুদ্ধে সরব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। কিছু কর্মসূচি পালনের পর ৪ জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকেরা৷ এরপরও দাবির বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না দেখে ৪ জুন ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গত সপ্তাহে টানা তিন দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। প্রত্যয় স্কিমের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটেও শিক্ষকনেতারা জোরালো বক্তব্য দেন৷
এত দিন কর্মবিরতি পালিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষাগুলো এর আওতার বাইরে ছিল। কিন্তু কাল থেকে যে সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু হচ্ছে, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষাসহ দাপ্তরিক সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন শিক্ষকেরা।
আজ দুপুরে কলাভবনের ফটকে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া। এতে বলা হয়, প্রত্যয় স্কিম বাস্তবায়ন করা হলে বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, যাঁরা আগামী দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় আসতে আগ্রহী, তাঁরাও এর ভুক্তভোগী হবেন। কাজেই আমাদের এ আন্দোলন আগামী দিনের তরুণ সমাজের স্বার্থরক্ষার পক্ষে এবং উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ধ্বংসের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। আমরা এখনো আশা করি যে সরকার অবিলম্বে এই যৌক্তিক দাবি মেনে নেবে, যাতে আমরা ক্লাসে ফিরে যেতে পারি। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ১ জুলাই থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।
নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘সরকারের একটি কায়েমি গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করে প্রত্যয় স্কিম চালু করিয়েছে। এই স্কিম বৈষম্যমূলক। আমরা শিক্ষকেরা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই। আমরা বিভিন্নভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা কোনো আগ্রহ দেখাননি। ফলে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ ছিল না।’
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা বলেন, বৈষম্যমূলক প্রত্যয় স্কিমকে শিক্ষকসমাজ প্রত্যাখ্যান করেছে। কাল ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এটি আমাদের অত্যন্ত আনন্দ ও গর্বের দিন। কিন্তু শিক্ষকদের ওপর প্রত্যয় স্কিম চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কোনো কর্মসূচিতে শিক্ষকেরা যাবেন না।
ঢাবির সব ক্লাস–পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ
কাল থেকে শুরু যাওয়া সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কর্মসূচিও ঘোষণা করেন জিনাত হুদা। এগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের সব ক্লাস বন্ধ থাকবে, অনলাইন-সন্ধ্যাকালীন ক্লাস ও শুক্র-শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস বন্ধ থাকবে, সব পরীক্ষা বর্জন করা হবে, বিভাগীয় চেয়ারম্যান বিভাগীয় অফিস-সেমিনার-কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগার বন্ধ রাখবেন, একাডেমিক কমিটি-সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি ও প্রশ্নপত্র সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হবে না, অনুষদের ডিনরা তাঁদের কার্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন, নবীনবরণ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করা যাবে না, কোনো বাছাই বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে না, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালকেরা ইনস্টিটিউটের কার্যালয়, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখবেন, সন্ধ্যাকালীন, শুক্র ও শনিবারের ক্লাস বন্ধ থাকবে, বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালকেরা কোনো সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপের কর্মসূচি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন, বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষরা প্রাধ্যক্ষ কার্যালয় বন্ধ রাখবেন এবং প্রধান গ্রন্থাগারিক কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বন্ধ রাখবেন।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি মো. আখতারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এত দিন পর্যন্ত আলোচনার জন্য ডাকা হয়নি। প্রত্যয় স্কিম চরম অপরিপক্ব হাতের কাজ এবং বিভ্রান্তিকর। এই স্কিম বাতিল করতে হবে। যারা প্রধানমন্ত্রীকে এই কুপরামর্শ দিয়েছে, তারা ষড়যন্ত্রকারী। আমরা নিজেদের সুবিধার জন্য আন্দোলন করছি না, করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য।’
সংবাদ সম্মেলনের আগে ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম অহিদুজ্জামান, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. আবদুর রহিম, বর্তমান কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান, সদস্য আ জ ম শফিউল আলম ভূঁইয়া, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষক সমিতির শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মিজানুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোতাহের হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. মমিন উদ্দিন প্রমুখ বক্তব্য দেন৷
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনও চলছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী, কারিগরি কর্মচারী ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংগঠন কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ আজ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করছে। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে তাঁরা প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি মো. আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাল থেকে শিক্ষকদের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদও অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে যাচ্ছে। আমরা অফিসে যাব, কিন্তু কোনো কাজ করব না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।’