এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষা বাতিল নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া

এইচএসসির ফল প্রকাশের পর নটর ডেম কলেজের দৃশ্য। এটি ফাইল ছবিছবি: দীপু মালাকার

বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের পর তা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি পরীক্ষার্থীদেরও অনেকেই এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। অনেকেই বলছেন, পরীক্ষা না দিয়ে ফলাফল প্রকাশিত হলে তা মন্দ নজির হয়ে থাকবে, যা শিক্ষার্থীদের পরবর্তী জীবনে ভুগতে হবে।

যদিও পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলন করেছিলেন তাঁদের যুক্তি হলো, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরীক্ষা বন্ধ থাকায় তাঁদের মানসিক চাপে ফেলেছে। এ ছাড়া কোটা আন্দোলনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত নন। অনেক সহপাঠী আহত, হাসপাতালে ভর্তি। এ অবস্থায় তাঁরা স্থগিত পরীক্ষাগুলো আর দিতে চান না। তাই তাঁরা ইতিমধ্যে হওয়া পরীক্ষা এবং স্থগিত বিষয়ে এসএসসির সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে (ম্যাপিং) এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের পক্ষে তাঁরা।

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা না হওয়ায় সবাই পাস করেন। তখন এসএসসি, জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের গড় মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল।

এতে শিক্ষার্থীদেরই ভুগতে হবে। তাই কষ্ট হলেও পরীক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। সরকারেরও পরীক্ষাটি নেওয়া দরকার ছিল
আমিরুল আলম খান, সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড

নটর ডেম কলেজের সাধারণ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের নামে দেওয়া একটি বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে তাঁরা বলছেন, এইচএসসির ফলাফল শুধু এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত। মোট কথা, তাঁদের অবস্থানটি পরীক্ষার পক্ষে। তবে তাঁরা বলছেন, শুধু আহত (ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত) শিক্ষার্থীদের তালিকা করে তাঁদের বিষয় ‘ম্যাপিং’ কিংবা ‘অটোপাস’, আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের অবশিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নই এই সমস্যার সমাধান বলে তাঁরা মনে করছেন।

ফাইল ছবি

এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী সাড়ে ১৪ লাখের মতো। পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। সাতটি পরীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছিল। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত ছয়টি পরীক্ষা বাকি ছিল। ব্যবহারিক পরীক্ষাও হয়নি। এরই মধ্যে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় ১১ আগস্ট থেকে নতুন সময়সূচিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে। যদিও সেটা হয়নি। কারণ হিসেবে শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির দিন বিভিন্ন এলাকায় থানায় হামলা হয়েছিল। এতে থানায় রাখা প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য ১১ আগস্টের পরিবর্তে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

কিন্তু আন্দোলনকারী পরীক্ষার্থীদের দাবি ছিল, অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে হবে। এ দাবিতে গত সোমবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করেছিলেন পরীক্ষার্থীরা। এরপর দাবি আদায়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ের সামনে আসেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে সচিবালয়ের পূর্ব দিকের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন তাঁরা।
একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবনের নিচে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তাঁরা ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’, ‘দাবি মোদের একটাই, পরীক্ষা বাতিল’, ‘পরীক্ষা না বিকল্প, বিকল্প বিকল্প’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এর আগে দুপুরে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এইচএসসি ও সমমানের বাকি পরীক্ষা অর্ধেক প্রশ্নোত্তরে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে আগে যদি আটটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো, সেখানে চারটির উত্তর দিলে হবে। এ ছাড়া সংশোধিত সময়সূচি অনুযায়ী, পরীক্ষা ১১ সেপ্টেম্বর থেকে আরও দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

আরও পড়ুন

কিন্তু শিক্ষার্থীরা এমন সিদ্ধান্ত মানেননি। তাঁরা দাবি পূরণে এক ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। বিকেল চারটার দিকে শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ের ১৮ তলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উঠে যান। শিক্ষার্থীরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের দপ্তর ঘেরাওসহ এখানে-সেখানে অবস্থান নেন। এ পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের দপ্তরের সামনে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সংগঠন আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতিও। তপন কুমার সরকার বলেন, স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করা হয়েছে। এখন ফলাফল কীভাবে দেওয়া হবে, তা পরে ঠিক করা হবে।

নানা প্রতিক্রিয়া

ওই সিদ্ধান্তের পর থেকেই নানা রকমের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নটর ডেম কলেজের সাধারণ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের নামে দেওয়া একটি বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে তাঁদের অবস্থানটি পরীক্ষার পক্ষে।
এভাবে সম্পূর্ণ পরীক্ষা বাতিলের বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহও সমর্থন করেন না বলে গতকাল গণমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। অন্যদিকে ফেসবুকে অসংখ্য মানুষ পরীক্ষা বাতিলের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি ও মানসিক স্বস্তির জন্য আরেকটু বেশি সময় দিয়ে যেকোনোভাবে হোক পরীক্ষা নিলে আদতে শিক্ষার্থীদের ভালো হবে। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাই এ বিবেচনায় পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক বলেও মনে করেন কেউ কেউ।

বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক ফাহমিদুল হক তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন ‘এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি বাতিল হোক।’ এ রকম অনেকেই নানা ধরনের মন্তব্য করছেন।

স্থগিত পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্তটি ভালো নজির হবে না বলে মনে করেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এতে শিক্ষার্থীদেরই ভুগতে হবে। তাই কষ্ট হলেও পরীক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। সরকারেরও পরীক্ষাটি নেওয়া দরকার ছিল।

আরও পড়ুন