এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে করোনার আগের ধারা
এবার পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।
জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭৮ হাজার ৫২১ জন।
করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষাই হয়নি। ভিন্ন মূল্যায়নে তখন সবাই পাস করেছিলেন। পরের বছর শুধু বিভাগভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছিল। তখন পাসের হার হয়েছিল প্রায় ৯৬ শতাংশ। আর গতবার (২০২২) পরীক্ষা হয়েছিল একেকটি বিষয়ে অর্ধেক নম্বরের ভিত্তিতে। তখন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে পরীক্ষাই হয়নি। তাতে পাসের হার হয় ৮৪ শতাংশের বেশি।
কিন্তু এবার পুনর্বিন্যাস করা পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা হলেও একটি বাদে সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে পূর্ণ নম্বরে। শুধু আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষা শেষ সময়ে এসে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ৭৫ নম্বরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এবার ফল আগের তিন বছরের তুলনায় বেশ খারাপ হয়েছে। পাসের হার গতবারের চেয়ে ৮ শতাংশ কমে গেছে। আর ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ কমেছে গতবারের চেয়ে অর্ধেকের বেশি।
এতে অবরোধের মধ্যেও অনেক কলেজে আনন্দ-উল্লাস হয়েছে। তবে উপস্থিতি তুলনামূলক কম দেখা গেছে। অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনেই ফল পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকেও খুশির এই খবর অনেকেই ভাগাভাগি করেছেন।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১১ লাখ ১২ হাজার ৩৭২ জন। এর মধ্যে পাস করেছেন ৮ লাখ ৪৪ হাজার ২৬৯ জন। পাসের হার ৭৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭৮ হাজার ৫২১ জন পরীক্ষার্থী।
গতকাল রোববার প্রকাশিত হয়েছে এই পরীক্ষার ফল। একই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিম ও কারিগরি বোর্ডের অধীন এইচএসসি (ভোকেশনাল, বিএম, ডিপ্লোমা ইন কমার্স) পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশিত হয়েছে। এইচএসসির মতো কারিগরি ও মাদ্রাসায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল প্রকাশের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এরপর বেলা ১১টা থেকে শিক্ষার্থীরা ফল পেতে থাকেন। এতে অবরোধের মধ্যেও অনেক কলেজে আনন্দ-উল্লাস হয়েছে। তবে উপস্থিতি তুলনামূলক কম দেখা গেছে। অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনেই ফল পাওয়া যাচ্ছে। ফেসবুকেও খুশির এই খবর অনেকেই ভাগাভাগি করেছেন।
এরপর বেলা আড়াইটায় সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
করোনা শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৭২ শতাংশ। এবার পাসের হার প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে পাসের হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ, আর ২০১৬ সালে ছিল ৭২ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ওই বছরগুলোতে পাসের হারের তারতম্য কাছাকাছি থাকত। এবারের ফলাফল ওই সময়ের ফলাফলকে মনে করিয়ে দিল।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষার দিকে যত এগোচ্ছে, পরীক্ষার ফলও তুলনামূলকভাবে খারাপ হচ্ছে। করোনার আগের অবস্থায় ফিরছে ফলাফল। তবে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা এই ফলকে খারাপ বলতে চান না। তাঁরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির আগের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে বরং এবারের ফলাফল ভালো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বললেন, করোনা শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৭২ শতাংশ। এবার পাসের হার প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে পাসের হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ, আর ২০১৬ সালে ছিল ৭২ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ওই বছরগুলোতে পাসের হারের তারতম্য কাছাকাছি থাকত। এবারের ফলাফল ওই সময়ের ফলাফলকে মনে করিয়ে দিল।
ফলাফলের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারও সেই পুরোনো বিষয়, ইংরেজির প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলাফলের ওপর। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের কয়েকটি বিষয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার ইংরেজি বিষয়ে তুলনামূলকভাবে খারাপ ফল করেছেন শিক্ষার্থীরা।
এর মধ্যে কোনো কোনো শিক্ষা বোর্ড ইংরেজিতে বেশি খারাপ করেছে। যেমন যশোর শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে পাসের হার ৭৭ শতাংশের কিছু বেশি। এই বোর্ডে এবার পাসের হারও সবচেয়ে কম। ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৭৫ শতাংশের মতো। এই বোর্ডেও পাসের হার সার্বিক গড় পাসের হারের চেয়ে কম।
এবার সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে। এ ছাড়া এবার যাঁরা পাস করেছেন, তাঁরা করোনার সময়ে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়তেন। সেই সময়ে অনলাইন ক্লাসের ফলে অনেকেরই ভিত্তি একটু দুর্বল ছিল।নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও
অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডেও এই বিষয়ে তুলনামূলক ফল খারাপ হয়েছে। আর বাধ্যতামূলক এই বিষয়ে খারাপ ফল হওয়ায় সার্বিক ফলের ওপর প্রভাব পড়েছে।
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ফলাফলে ইংরেজির একটি প্রভাব পড়েছে।
গতবারের চেয়ে জিপিএ-৫ কমেছে ৮১ হাজার
পাঁচ বছরের তুলনামূলক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার আগে ২০১৯ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৪১ হাজার ৮০৭ জন। পরের বছর বেড়ে হয়েছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬১৪ জন। ২০২১ সালে তা বেড়ে হয় ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন এবং এর পরের বছর পান ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৫ জন। এবার তা কমে হয়েছে এবার ৭৮ হাজার ৫২১। গতবারের চেয়ে এবার ৮১ হাজার ২৩৪ জন শিক্ষার্থী কম জিপিএ-৫ পেয়েছেন।
এগিয়ে ছাত্রীরা
জিপিএ-৫ ও পাসের হার—উভয় দিক দিয়েই এবার ছাত্রীরা এগিয়ে আছেন। এবার ৯ বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ছিলেন ৫ লাখ ৮২ হাজার ৯৪৪ জন। তাঁদের মধ্যে পাস করেছেন ৪ লাখ ৫৮ হাজার ২৬৬ জন। পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। আর মোট জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৪১ হাজার ৮০৪ জন। অন্যদিকে ৫ লাখ ২৯ হাজার ৪২৮ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাস করেছেন ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৩ জন। পাসের হার প্রায় ৭৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ৩৬ হাজার ৭১৭ জন।
এগিয়ে বরিশাল, পিছিয়ে যশোর
পাসের হারের দিক দিয়ে এবার সবচেয়ে এগিয়ে আছেন বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এই বোর্ডে পাসের হার ৮০ দশমিক ৬৫; যা সার্বিক পাসের হারের চেয়ে ৫ শতাংশের মতো বেশি। আর যশোর শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার প্রায় ৭০ শতাংশ; যা ৯টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে কম। আর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর হিসাবে বরাবরের মতো এবারও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এগিয়ে আছে। এই বোর্ডের মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩১ হাজার ৭৫২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন। জিপিএ-৫ সবচেয়ে কম পেয়েছেন সিলেট শিক্ষা বোর্ডে (১৬৯৯ জন)।
শূন্য ভাগ, শতভাগ পাসের চিত্র
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে। এ বছর শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৪২টি। ২০২২ সালে ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। এদিকে এবার সবাই পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে। ৯৫৩ প্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থী এ বছর পাস করেছে। গতবার এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৩০টি।
এবারের ফলাফল প্রসঙ্গে নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, এবার সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে। এ ছাড়া এবার যাঁরা পাস করেছেন, তাঁরা করোনার সময়ে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়তেন। সেই সময়ে অনলাইন ক্লাসের ফলে অনেকেরই ভিত্তি একটু দুর্বল ছিল। তবে তাঁর কলেজে শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছে বলে জানান।