র্যাগিং নয়, মমতায় আঁকড়ে থাকি

র‌্যাগিং নয়, নবীনদের বরণ হোক আনন্দ উৎসবে। মডেল: জাওয়াদ ও পরমা। ছবি: খালেদ সরকার
র‌্যাগিং নয়, নবীনদের বরণ হোক আনন্দ উৎসবে। মডেল: জাওয়াদ ও পরমা। ছবি: খালেদ সরকার
১২ জানুয়ারি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু হয়েছে নতুন একটি শিক্ষাবর্ষ। নবীন ছেলেমেয়েরা যেন র‌্যাগিংয়ের শিকার না হন, সেই পরিবেশ গড়ে তুলতে শিক্ষার্থীরাই তো বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।


বয়সে, চাহনিতে, হাসিতে, অকারণেই এদিক-ওদিক ছোটাছুটিতে কিংবা জীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু করার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেই ওরা জানান দেয় ওরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ওরা নতুন। হলেও উঠেছে কেউ কেউ। ছোট ছোট মেয়েদের মাঝেমধ্যে দেখি হলের বারান্দায়, করিডরে উদাস হয়ে বসে আছে। হয়তো বাড়ির কথা মনে পড়ছে। ফেলে আসা মা–বাবা, আদরের ভাইবোন, পাড়া–প্রতিবেশী, ফেলে আসা দুই বেণির কিশোরীজীবন। আহা! ১৮, আহা মধুর বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। ক্লাস-পরীক্ষার বাইরে রাত জেগে আড্ডা, টিএসসি, লাইব্রেরি, গান-বাজনা, আবৃত্তি, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, নাটক—কী নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে। এ যেন স্বপ্নের ওড়াউড়ি। কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি অবস্থা! ওদের সেই দুরন্তপনা আমাকে নিয়ে যায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের দিনগুলোয়।

এই স্বপ্নমাখা চোখগুলোও হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে ওঠে। কাঁদায়, কাঁপায়। মনে থাকা স্বপ্নগুলোকে নাগরদোলায় ঘোরাতে থাকে। এই প্রথম বর্ষেই অনেকেই শিকার হয় র‌্যাগিং নামের এক মহা যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে শুরু হয় এক তুমুল ভাঙচুর। একটুখানি থাকার জায়গার জন্য এলাকার বড় ভাই কিংবা পরিচিত কোনো ‘ছাত্রনেতা’র মাধ্যমে হয়তো অনেকেই অনুরোধ করে। তাদের মাধ্যমে হলে থাকে। ওঠে হলের গণরুমে। সেখানেই অনেকের জীবনে আঘাত হানে র‌্যাগিং নামের নিপীড়নের অভিজ্ঞতা।

র‌্যাগিংয়ের ইতিহাস

র‌্যাগিং শুরু হয়েছিল গ্রিক সংস্কৃতি থেকে। এই র‌্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ হচ্ছে ‘পরিচয়পর্ব’ এবং খুব ইতিবাচক অর্থেই এটির চর্চা শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরোনো শিক্ষার্থীদের একটা সখ্য গড়ে তোলার জন্য যে পরিচিতি প্রথা, সেটাকেই র‌্যাগিং বলা হতো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র‌্যাগিং বিস্তার লাভ করে এবং এর চর্চার ধরনের জন্য প্রশংসিতও হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে এটি বিস্তৃত হতে থাকে। বর্তমানেও ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে এর চর্চা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে বাংলাদেশে এটি প্রকট হয়ে ওঠে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বা তারও কিছু আগে। জুনিয়রদের নিয়ে এই র‌্যাগিংয়ে সাধারণত তাদের সিনিয়র শিক্ষার্থীরাই থাকে। তবে সবাই নয়, থাকে শুধু কিছু নির্ধারিত সিনিয়র এবং এই সিনিয়ররা সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতাসহ নানা ধরনের ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ভর্তি হয়, তারাই সবচেয়ে বেশি র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়।

মজা থেকে নির্যাতন

দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই র‌্যাগিংয়ের চর্চা সবচেয়ে বেশি এবং কয়েক বছর ধরেই এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলছে সবচেয়ে বেশি। রয়েছে সরকারি মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কলেজসহ খ্যাতনামা সব উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানও। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘জুনিয়রদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া’, ‘জুনিয়র-সিনিয়র সম্পর্ক উন্নয়ন’, ‘মজা করা’ বা ‘জুনিয়রদের আদব-কায়দা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম শেখানো’র নামে র‌্যাগিং চলে। অনেক সময়ই হয়তো নিছক মজার ছলে শুরু হয় র‌্যাগিং। কিন্তু জুনিয়রদের নিয়ে সিনিয়রদের এই মজা ক্রমেই রূপ নেয় নির্যাতনে। সেখানে সিনিয়দের ‘সালাম’ না দেওয়া, অমুক ভাইয়ের নাম না জানা কিংবা চিনতে না পারা থেকে শুরু করে প্রথমে সামান্য গালাগালি, এরপর হুমকি-ধমকি দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হয় শারীরিক নির্যাতনে। পরিচিত পদ্ধতির সঙ্গে বিভিন্ন অভিনব কায়দায় চলে নির্যাতন।

নতুন শিক্ষার্থীদের জোর করে সব রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের পরিচয় মুখস্থ করানো, মা–বাবা ও পরিবারের অন্যদের জড়িয়ে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার, প্রকাশ্যে নগ্ন করা, পেস্ট খেতে বাধ্য করা, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর রুমে আসা, রাতে মশার কামড় খাওয়ানোর জন্য বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে ওঠবস, বুকডন, মুরগির মতো বসিয়ে রাখা, শীতের মধ্যে পানিতে নামানো ও ফুটবল খেলতে বাধ্য করা, শীতের রাতে সিনিয়রদের কাজে বাইরে পাঠানো, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম বা মাঠের মাপ নেওয়া, কোনো আদেশ না মানলে গায়ে হাত তোলা, কথার মারপ্যাঁচে বিব্রত করা ছাড়াও নানাভাবে র‌্যাগিং চলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে। মেয়েদের হলগুলোও যে র‌্যাগিংমুক্ত, এমন বলা যাবে না। সেখানেও চলে নানা ধরনের নিপীড়ন। রুমে নতুন জায়গা পাওয়া মেয়েটিকে কখনো কখনো বাধ্য করা হয় রুম মোছার জন্য, সিনিয়র আপুদের খাবার নিয়ে আসাসহ অন্যান্য ফরমাশ খাটার জন্য। 

সবার দায়িত্বপূর্ণ আচরণ, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসার সম্পর্কের মধ্য দিয়েই দূর হবে র‌্যাগিংয়ের মতো ভয়াবহ বিষয়। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে
সবার দায়িত্বপূর্ণ আচরণ, শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসার সম্পর্কের মধ্য দিয়েই দূর হবে র‌্যাগিংয়ের মতো ভয়াবহ বিষয়। ছবি: স্বপ্ন নিয়ে

স্বপ্নের ক্যাম্পাসে এসে সিনিয়রদের এমন আচরণ মেনে নিতে পারে না অনেকেই, পারার কথাও নয়। তাই অনেকে বাধ্য হয় হল বা ক্যাম্পাস ছাড়তে। অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এই ক্ষত থেকে সহজে বের হতে পারে না।

করণীয় কী 

এখন তাহলে এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী হবে? বন্ধুদের করণীয় কী? অভিভাবকদের করণীয় কী? 

১২ জানুয়ারি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধিভুক্ত কলেজে র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। র‌্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীদের জরুরি সাহায্য ও দ্রুত প্রতিকার দিতে এই কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অতিদ্রুতই এই র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি করবে।

আমরা সবাই আমাদের জায়গা থেকে সতর্ক থাকব। কেউ যদি র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার প্রতি পরিবার ও বন্ধুদের সহমর্মী আচরণ তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি তাকে এই তথ্য জানাতে হবে কর্তৃপক্ষকে। যদি হলে ঘটে, তাহলে হল কর্তৃপক্ষকে, আর যদি বিভাগে ঘটে, তাহলে বিভাগীয় সভাপতি কিংবা ছাত্র উপদেষ্টাকে জানাতে হবে। প্রতিটি বিভাগেই রয়েছে ছাত্র উপদেষ্টা। অভিভাবকদেরও প্রয়োজনে যুক্ত হতে হবে এই প্রক্রিয়ায়। সবার দায়িত্বপূর্ণ আচরণ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্কের মধ্য দিয়েই দূর হবে র‌্যাগ দেওয়ার মতো ভয়াবহ বিষয়। 

বড়দের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। আদর–স্নেহ নিম্নগামী। ছোটরা আদরের। পরিবার আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। ভালোবেসে কাছে টেনে নেওয়ার যে সম্পর্ক, সেটাই সারা জীবনের অর্জন। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন এ জন্যই অনন্য।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।