উচ্চশিক্ষায় বছরজুড়ে অস্থিরতা
গত এক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে দৃশ্যমান কাজ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকার পর সারা দেশের ২ হাজার ৭৩৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা একটি বড় কাজ। কিন্তু সোয়া বছর ধরে যাচাই–বাছাই করার পরও নতুন এমপিওভুক্তিতে বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে যেমন নতুন করে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, তেমনি এমপিওভুক্ত হওয়ার খবর শুনে ‘অস্তিত্বহীন’ প্রতিষ্ঠানে রাতারাতি ঘরও উঠেছে। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্ত হয়েছে।
ভালো-মন্দ মিলিয়ে এটিকেই চলতি বছরের বড় কাজ বলছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর বাইরে গত এক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে দৃশ্যমান বড় কাজ নেই; বরং জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে শিক্ষা আইন করাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কাজ আটকে গেছে। তবে বছরজুড়ে উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা ও সমস্যা লেগেই ছিল। সব মিলিয়ে শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতির বিষয়টিই বারবার সামনে এসেছে।
অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেছেন, শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে তাঁরা কাজ করছেন। এ জন্য যুগোপযোগী শিক্ষাক্রমও প্রণয়ন করা হচ্ছে। শিক্ষা আইনের খসড়াও শিগগিরই চূড়ান্ত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অস্থিরতা
চলতি বছর অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী গত ৬ অক্টোবর আবরার ফাহাদ নামের এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে দুই মাস বন্ধ ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। পরে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নিলে বুয়েটে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংসহ বিভিন্ন কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের চিত্র সামনে আসে।
উপাচার্যের মধ্যস্থতায় উন্নয়নকাজের টাকার ভাগ ছাত্রলীগ নেতাদের দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত আগস্ট থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা চলছে। এ কারণে গত ৫ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ ছিল।
অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে গত ৩০ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। এখন দুদক তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে। কিন্তু প্রায় তিন মাস হতে চললেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। একজন ডিন উপাচার্যের রুটিন কাজ করে যাচ্ছেন।
এক চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে উপাচার্যের টাকা নেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত অক্টোবরে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক চাকরিপ্রার্থীর স্ত্রীর মুঠোফোনে সহ–উপাচার্য টাকা লেনদেনের কথা বলেন, যার অডিও রেকর্ড ফাঁস হলে আন্দোলন শুরু হয়। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একটি বক্তব্য নিয়েও আন্দোলন হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকায় প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। পরে নতুন উপাচার্য এসে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঠিক করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ছুটির নামে সাবেক উপাচার্য এস এম ইমামুল হক বিদায় নিতে বাধ্য হন। গত নভেম্বরের শুরুতে সংঘর্ষের ঘটনায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিল। গত ১৩ জুন থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলেছে নিয়মিত উপাচার্য ছাড়াই। ফলে তখন গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত আটকে গিয়েছিল। পরে গত ৩ নভেম্বর সহ-উপাচার্য শিরীণ আখতারকে নিয়মিত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে না থাকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা আছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় ২৯ বছর পর এ বছরের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হওয়া ছিল একটি বড় ঘটনা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি ডাকসু। সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর ভিপি নুরুল হক ও তাঁর সহযোগীদের ডাকসুর কক্ষে আলো নিভিয়ে বেদম পেটান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি সংগঠনের কর্মীরা। এ নিয়ে এখন ক্ষোভ–বিক্ষোভ চলছে।
স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাণিজ্যিকভাবে চলা সন্ধ্যাকালীন কোর্স নিয়ে সমালোচনা আগেও ছিল। কিন্তু ৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির মুখে সেই সমালোচনার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। একে একে বন্ধ হতে চলেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধ্যাকালীন কোর্স।
২০১৯ সালের একটি ইতিবাচক দিক হলো, কৃষি ও কৃষির প্রাধান্য থাকা সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় একই দিনে অভিন্ন পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সমস্যা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বাকিগুলোর মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার মূল পদ উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়মিত নিয়োগের ব্যবস্থা নেই বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে। এই তিন পদে কেউ না থাকায় সম্প্রতি আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন নির্ধারিত তারিখের আগের দিন স্থগিত করতে হয়েছিল।
উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউজিসিকে শক্তিশালী করার জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন করার কথা বলা হলেও তা আটকে আছে; বরং এটি করার জন্য এমন একটি খসড়া করা হয়, যেখানে কার্যত প্রতিষ্ঠানটি আরও ক্ষমতাহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন ইউজিসির কর্মকর্তারা। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে অ্যাক্রেডিটেশনের কাউন্সিল গঠিত হলেও এর কার্যকারিতা চোখে পড়ছে না।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক কারণে সমস্যা হচ্ছে। কোথাও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, আবার কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকসমাজের গাফিলতি আছে। বুয়েটসহ কোথাও কোথাও ছাত্র নামধারী দুষ্কৃতকারীদের বেপরোয়া আচরণ দেখা গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গুটিকয়েক বাদে বাকিগুলোর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেকগুলোতে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই।
দীর্ঘসূত্রতা বেড়েছে
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম বড় কাজ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। কিন্তু ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখন পর্যন্ত যথাযথভাবে সেটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘শিক্ষা আইন’ করা হয়নি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত হলেও বর্তমান সরকার খসড়াটি নতুন করে পর্যালোচনা করছে। ফলে দেরি হচ্ছে। আগের খসড়ায় কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বর্তমান নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ চান, সব কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ না হোক।
প্রায় দেড় বছর আগে দেশের ৩০১টি কলেজ জাতীয়করণ হলেও এসব কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি এখনো সরকারি হয়নি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ওই সব কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী।
প্রাথমিক শিক্ষা
প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের বড় সমস্যা নানা ধরনের পরীক্ষা। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, ২০২১ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত পরীক্ষা থাকবে না। বছরের শেষ পর্যায়ে এসে একজন মন্ত্রী জানিয়েছেন, পঞ্চম শ্রেণিতে হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থাকবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া হবে।
বেতন স্কেল নিয়ে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনও এ বছরের আলোচিত বিষয়। পরে তাঁদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পর্যালোচনাতেও দেখা যাচ্ছে, এ বছর উচ্চশিক্ষায় সমস্যা বেশি ছিল। বুয়েটের আবরার হত্যার মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতির কলুষিত রূপ বেরিয়ে আসে। এ জন্য র্যাগিংসহ নির্যাতনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে নিয়মিত তদারক করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে। শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করে তার আগপর্যন্ত প্রথাগত পরীক্ষা বন্ধ এবং দ্রুত সময়ে সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।