একজন সদা হাস্যোজ্জ্বল তপনদা
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি) তপনদা এসেছিলেন ১৯৯১ সালে, আর এখন ২০১৯। ৯১ আর ১৯—অঙ্ক দুটি স্থান পরিবর্তন করলেও তপনদার মুখের হাসিটা একই রয়ে গেছে। ২৮ বছর ধরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার প্রিয় একটি নাম—তপনদা।
সব সময় ছিমছাম, পরনে শার্ট আর লুঙ্গি। মুখে সব সময় জ্বলজ্বল করে হাসি। তাঁর আসল নাম অজিত কুমার পাল। তপন নামটা এই ক্যাম্পাসেরই দেওয়া। টানা চার বছর খুবির অনেক শিক্ষার্থীর সকাল শুরু তাঁর হাতের চা খেয়ে। দোকনটাও ছিমছাম, যেমন ছিমছাম তিনি। একটা টিনের চৌচালা ঘর। কিছু বসার জায়গা। খাবারের মেনুতে শিঙাড়া, পুরি আর চায়ের মতো টুকটাক খাবার। রাতে তপনদার হ্যাজাক বাতির আলোতে ক্রমে জমে ওঠে শিক্ষার্থীদের আড্ডা।
ক্যাম্পাস কেমন লাগে? জিজ্ঞাসা করতেই তপনদা একমুখ হাসি নিয়ে বলেন, ‘শান্তি লাগে দাদা।’ তিনি বলেন, ‘ছোট ক্যাম্পাসটাকে ধীরে ধীরে বদলাতে দেখেছি। একসময় যে ছাত্ররা আমার দোকানে চা খেতেন, তাঁরাই আজ বড় শিক্ষক বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তাঁরা যখন এসে তপনদা বলে ডাক দেন, মনটা ভরে যায়।’
তপনদা মনে হলো কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হলেন, ‘ক্যাম্পাসে যখন আসি, তখন আমি সদ্য প্রাইমারি স্কুল পার করা ১৪ বছরের একটি ছেলে। আমরা ছিলাম ৯ ভাইবোন। আমাদের পড়ালেখা করানোর মতো অবস্থা বাবার ছিল না। একদিন মাটি কাটতে আসি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর সিদ্ধান্ত নিই চায়ের দোকান দেব। প্রথম দিকে মেইন গেটের পাশে একটি ছোট দোকান শুরু করি। ২৮ বছরে আমি ১৪ বার দোকান ভেঙেছি, আবার গড়েছি।’
ক্যাম্পাসে কোনো খারাপ স্মৃতি আছে কি না, জিজ্ঞাসা করলে তপনদা বলেন, ‘কোনো খারাপ স্মৃতি নেই—যা আছে সব ভালো স্মৃতি। আমার ভালো লাগে যখন ছাত্রছাত্রীরা আমার দোকানে আসে, বসে গল্প করে। ভিসি স্যারও আসেন। চা খান। খুব ভালো লাগে।’
শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা কীভাবে তাঁকে ঋণী করেছে, বললেন সে কথাও। ‘২০০৬ সালের দিকে একবার প্রশাসন আমার দোকান উচ্ছেদের নোটিশ পাঠায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করে একটি চিঠি প্রশাসনের কাছে পাঠান। আমি আবার দোকান শুরু করি।’
তপনদার দোকানে নেই হিসাব রাখার কেউ। যা খাবেন, হিসাব আপনার নিজেকেই করতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বললেন, ‘ছাত্রদের নিয়েই আমার এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সত্যি বলতে, এ জন্যই আমার কখনো ক্ষতি হয়নি। তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারি।’