প্রোগ্রামিং-প্রিয় ছেলেটিই বুয়েটে প্রথম
মো. মেহরাব হকের কথায় ঘুরেফিরে বারবার চলে আসে কম্পিউটার সফটওয়্যার, প্রোগ্রামিং, রোবট বা কোডিংয়ের প্রসঙ্গ। আমরা প্রশ্ন করি, ‘অবসর সময়ে কী করেন?’
‘প্রোগ্রামিং করি।’
-পড়ালেখার বাইরে আর কিসের প্রতি আপনার আগ্রহ? খেলাধুলা, সিনেমা দেখা, গান শোনা...
‘গান তো সেভাবে শোনা হয় না। তবে আমি একবার একটা টিউনিং সফটওয়্যার বানিয়েছিলাম।’
-ভবিষ্যতে কী নিয়ে কাজ করতে চান?
‘বাংলাদেশেই বিশ্বমানের সফটওয়্যার তৈরি করতে চাই।’
আমরা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার চেষ্টা করি।
-কলেজজীবনের কোনো মজার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারেন?
‘একবার বন্ধুর কম্পিউটার হ্যাক করার জন্য একটা সফটওয়্যার বানিয়েছিলাম...’
নাহ, বন্ধুরা যে এই ছেলেকে ‘রোবট’ বলে খ্যাপায়, সেটা একেবারে অহেতুক নয়! গত বুধবার, প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে আলাপের শুরুতেই মেহরাব তাঁর বানানো রোবট দেখাচ্ছিলেন। কোথায় কোন চিপ, কী সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন...ইত্যাদি। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে আমরা বলি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার গল্পটা আগে শোনা যাক।
হ্যাঁ, নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো এই তরুণ এ বছর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। মেহরাব ব্যাগের ভেতর রোবট তুলে রেখে বলতে শুরু করেন, ‘তেমন কোনো গল্প নেই। পড়ালেখা, পড়ালেখা এবং পড়ালেখাই আমাকে শেষ পর্যন্ত বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হতে সাহায্য করেছে। যখন নটর ডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হই, প্রথম বর্ষ থেকেই বুয়েটে ভর্তির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছি। যেমন পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের অঙ্কগুলো তিন মিনিটের মধ্যে শেষ করার চর্চা করতাম।’ আরও একটু নির্দিষ্ট করে জানতে চাই, আপনার এমন তিনটা বৈশিষ্ট্যের কথা বলুন, যা আপনাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে। উত্তরটা বোধ হয় তৈরিই ছিল। ঝটপট বললেন, ‘স্পিড, অ্যাকুরেসি এবং লজিক।’ অর্থাৎ দ্রুততা, নির্ভুল করার চেষ্টা এবং যুক্তি দিয়ে ভাবার দক্ষতাই মেহরাবকে প্রথম হতে সাহায্য করেছে।
উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময়েই বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার পুরোনো প্রশ্নগুলো সমাধান করতে শুরু করেছিলেন মেহরাব। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের জন্য বরাদ্দ থাকে ৩ মিনিট সময়। কলেজে পড়ার সময় থেকেই এই চর্চা শুরু করেছেন মেহরাব।
তবে রাতদিন যে শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকতেন তা নয়। মেহরাবের ভাষায়, তিনি পড়তেন আনন্দ নিয়ে। একটা ভালো না লাগলে আরেকটা পড়তেন। পদার্থবিজ্ঞান ভালো না লাগলে গণিত, গণিতে মন না বসলে বাংলা...। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর আলাদা টানের কথা জানা গেল মা সামরোজ আরার কথায়। মা বলছিলেন, ‘ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই ও একটা উপন্যাস লিখেছিল। নাম, তবুও আছ তুমি। নায়কের নাম ছিল...।’ মেহরাব মাকে থামিয়ে দেন, ‘থাক থাক, ওটা বাদ দাও।’ মা সামরোজ আরা একজন চিকিৎসক। বাবা কৃষিবিদ, নাম মো. এমদাদুল হক।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ‘স্বপ্ন নিয়ে’পাতায় ছাপা হয়েছিল বিগত চার বছরে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়া চার শিক্ষার্থীর পরামর্শ। প্রতিবেদনটা বেশ কাজে এসেছে বলে জানালেন মেহরাব। বলছিলেন, ‘এক ভাইয়া বলেছিলেন, অনেক সময় দেখা যায় আমরা একই বিষয় ঘুরেফিরে বারবার পড়তে থাকি, এটা যেন না হয়। কথাটা আমার এখনো মনে আছে।’ লেখাটা পড়ার সময় মেহরাব জানতেন না, শিগগিরই তিনিও এই ‘ভাইয়া’দের দলে যোগ দেবেন!
বুয়েটে কোন বিষয়ে ভর্তি হবেন?
উত্তরটা অনুমেয়ই ছিল—কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল। সবকিছু ঠিক থাকলে, শিগগিরই স্বপ্নের ক্যাম্পাসে শুরু হবে তাঁর যাত্রা। একসময় বড়দের পরামর্শ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এবার মেহরাবের পরামর্শ দেওয়ার পালা। জানতে চাই, এখন যারা কলেজে পড়ছে, যারা আপনার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সফল হতে চায়, তাদের জন্য আপনার তিনটি পরামর্শ কী হবে?
মেহরাব বললেন, ‘প্রথম পরামর্শ হলো, লেখাপড়ার প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরি করো। কখনোই এটাকে চাপ মনে করবে না। দ্বিতীয় পরামর্শ থাকবে, সামনে একটা বড় প্রতিযোগিতা, সেটাকে কোনোভাবেই ভয় পাবে না। বরং প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি থাকো। তৃতীয় পরামর্শ হলো, শিক্ষকদের সঙ্গে সব সময় ভালো আচরণ করবে, শ্রদ্ধা করবে। কারণ শিক্ষকেরাই কিন্তু তোমাকে সাহস দেবেন।’
নিজের ভবিষ্যৎ ভাবনাটা সাজিয়ে ফেলেছেন মেহরাব। মার্ক জাকারবার্গের মতোই দুনিয়া বদলে দেওয়া একটা কিছু তৈরি করতে চান তিনি। মেহরাব বলছিলেন, ‘একসময় আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম না। আমাদের আমদানি করতে হতো। বর্তমানে কিন্তু আমাদের কৃষক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের সহায়তায় আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও খাদ্য রপ্তানি করছি। সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে আমরা ততটা স্বয়ংসম্পূর্ণ না। আমরা যদি সফটওয়্যার তৈরি করে নিজেরা ব্যবহার করতে পারি, বিদেশে রপ্তানি করতে পারি, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশেরও একটা অবস্থান তৈরি হবে।’