ঢাকার মেয়ে কাজী হাবিবা কুমকুম। কৃষিবিদ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি)। কৃষি অনুষদের ১৭তম ব্যাচের এই ছাত্রী বলেন, ‘ভাবতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মানেই ছাত্ররাজনীতি, মারামারি, সেশনজট। কিন্তু এখানে এসে আমার সেই ভুল ভেঙেছে।’ ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি শোনা গেল ঢাকার উত্তরা থেকে আসা কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী তানিয়া হাসানের কণ্ঠেও। বলছিলেন, ‘জেলা শহরের বাইরে আমাদের কোলাহলমুক্ত ক্যাম্পাস। পাখির কিচিরমিচির, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ...সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে এলেই আমাদের মন ভালো হয়ে যায়।’
পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা সদরে ৮৯ দশমিক ৯৭ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কদিন আগে ক্যাম্পাস ঘুরে সত্যিই মন ভালো হলো। কথা হলো একঝাঁক তরুণের সঙ্গে।
কৃষি কলেজ থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০০০ সালের ৮ জুলাই পটুয়াখালী কৃষি কলেজের অবকাঠামোতেই পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৃষি অনুষদ নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা (বিবিএ), কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, প্রাণিবিজ্ঞান ও পশুচিকিৎসা, মাত্স্যবিজ্ঞান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন অনুষদ। ৮টি অনুষদে পড়ছেন ৩ হাজার ২৮৭ জন শিক্ষার্থী। স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রিও চালু আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবিষয়ক উপদেষ্টা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইমাদুল হক বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম সেরা আবাসিক ক্যাম্পাস। ছাত্রছাত্রীদের জন্য এখানে একাধিক হল আছে। আছে ডিজিটাল লাইব্রেরি। দুই তলাবিশিষ্ট লাইব্রেরি ভবনে ৫৫ হাজারেরও বেশি বই, ইন্টারনেট-ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক ভলিউম ও সাময়িকী রয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই অনুষদের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান এস এম তাওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ক্রেডিট কোর্স পদ্ধতিতে আমাদের এখানে পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা যেন আন্তর্জাতিক গবেষণার সঙ্গে তাল মেলাতে পারে, সে জন্য ২০০২ সাল থেকে স্নাতক পর্যায়ে কৃষি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা চালু করা হয়েছে। হাতে-কলমে পড়ানোর জন্য এখানে আছে ৩২টি সমৃদ্ধ গবেষণাগার। একাডেমিক ভবন, ছাত্রাবাসসহ পুরো এলাকায় ওয়াই-ফাই ইন্টারনেটের সুবিধা আছে।’
ক্যাম্পাসে নানা কার্যক্রম
পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম এবং খেলাধুলায় অংশ নেন পবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬টি সংগঠন সক্রিয় আছে—স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, পাঠচক্র, কবিতা পরিষদ, ব্লাড অ্যান্ড টিয়ার্স, মিরাকল, ডিবেটিং সোসাইটি, বাঁধন, সাইট (তথ্যপ্রযুক্তি ক্লাব), উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, নোঙর, ভয়েস অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, আমরা কজন, বৃত্ত, বিজনেস ক্লাব, ঘাসফুল, মুক্তধারা ও বিএনসিসি (নৌ-শাখা)। সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলার পাশাপাশি বসন্তবরণ, বর্ষবরণ, নবীনবরণ, বৈশাখী মেলা, রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের আয়োজন করে।
আড্ডার প্রাণকেন্দ্র লেক ও বকুলতলা
ক্যাম্পাসের চারটি লেক ও বকুলতলা শিক্ষার্থীদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। লেকগুলোর নাম খুব সুন্দর—লাল কমল, নীল কমল, তরঙ্গ তনু ও সালসাবিল। গত মঙ্গলবার নীল কমল লেকের পাশের ঘাটলায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন একদল শিক্ষার্থী। কেউ কৃষি, কেউ বিবিএ, আবার কেউ সিএসই বিভাগে পড়ছেন। খুলনার তুলি, তনিসা, রাকিবুল, মুসাব্বির ও সাব্বির, সাতক্ষীরার দেব ও ফরহাদ, যশোরের মাসুম বিল্লাহ, পিরোজপুরের অপু ও দ্বীপজ্যোতি, ময়মনসিংহের আকাশ, রাজবাড়ীর সুলতান, বরিশালের রূপামণি, সুদীপ্ত, দিলীপ, পটুয়াখালীর অনামিকা, দুলিয়া, সারা, উদয় শংকর, ভোলার হাসনাইন—সবাইকে এক করেছে এই ক্যাম্পাস।
শিক্ষার্থীরা জানালেন, নানা প্রজাতির গাছে ঘেরা প্রকৃতির এমন মনোরম সৌন্দর্য তাঁদের উজ্জীবিত করে, বন্ধনটা আরও গাঢ় করে।
ভিনদেশিরা জেনেছেন এ দেশের ইতিহাস
আমরা যেদিন ক্যাম্পাসে পা রেখেছি, সেদিন ৭ মার্চ। মাইকে বাজছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। পবিপ্রবির কয়েকজন নেপালি শিক্ষার্থী জানালেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাঁরা জানেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে ছবি তুলছিলেন তাঁরা।
বিদেশি শিক্ষার্থীরা ভাঙা ভাঙা বাংলায় নিজেদের পরিচয় দিলেন। লক্ষ্মী এসেছেন নেপালের মোরাং থেকে, রাহুলের বাড়ি জনকপুর, বিবেক কাঠমান্ডু ও অঙ্কিতা জলেশ্বর থেকে এসেছেন। পড়ছেন কৃষি অনুষদে। অঙ্কিতা জানালেন, সহপাঠীদের কাছ থেকে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস তাঁরা শুনেছেন। ক্যাম্পাসে জাতির জনক ও সাত বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য তাঁদের এসব ইতিহাস জানতে আগ্রহী করেছে।
লক্ষ্মী বললেন, ‘এখানে আসার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে সবুজ গাছগাছালির ছবি আর ফুল দেখে খুব ভালো লেগেছিল। ভর্তি হওয়ার পর বুঝেছি, ক্যাম্পাসটা ছবির চেয়েও সুন্দর।’
গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই
মো. হারুনর রশীদ
উপাচার্য, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি করাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য। ভিনদেশের বেশ কয়েকটি নামী ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আমাদের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশা করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার অগ্রগতিতে এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করছে। বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছে অনেকে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।