অবাক কুতুহলে ঢাকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখল উপকূলের মেয়েশিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশের উপকূলের পিছিয়ে পড়া মেয়েশিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ঢাকায় আয়োজিত হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্থান পরিদর্শনমূলক আয়োজন ‘অবাক কুতুহলে’। স্টেম অ্যান্ড আইসিটি স্কিলস ফর দ্য গার্লস অব কোস্টাল এরিয়া প্রকল্পের আওতায় গত শুক্র ও শনিবার (৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি) দিনভর ঢাকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শিক্ষার্থীরা।
সফটওয়্যারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্রেইনস্টেশন ২৩ ঘুরে যারপরনাই খুশি খুলনার রূপসা উপজেলার কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়মা সাদিয়া ঝিলিক। তার মতে, আজ সে এই অফিস পরিদর্শনে এলেও কোনো একদিন নিশ্চয়ই সে এ রকম প্রতিষ্ঠানের কর্মী হয়ে ঢাকায় ফিরবে। প্রতিষ্ঠানটির নারী কর্মীদের গল্প বেশ অনুপ্রাণিত করে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শহীদ আলী আহম্মদ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহরিয়া সুলতানা শাকিলাকে। সে বলে, ‘আমি গ্রামে যেটুকু পড়াশোনা করি, ভাবতাম সেটাই অনেক বেশি। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের আপুদের গল্প শুনে মনে হয়েছে, আমার এলাকার বাইরেও একটা বিস্তৃত জগৎ রয়েছে, যেখানে প্রবেশ করতে আমাকে আরও অনেক বেশি পরিশ্রম আর সাধনা করতে হবে।’
ঝিলিক ও শাকিলার মতো প্রায় ৩৬ শিক্ষার্থী ৬ ফেব্রুয়ারি বাসযোগে ঢাকা আসে রাজধানী শহর ঢাকা ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। তিনটি ভিন্ন এলাকার ছয়টি পৃথক বিদ্যালয় থেকে এলেও পুরো সফর তাদের একক বন্ধনে মিলিয়ে দেয়। তারা নিজেদের মধ্যে পরিচিত হয় এবং পুরো আয়োজনটি পরস্পরের সহযোগিতায় আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে। ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে তাদের ঢাকা পরিদর্শন শুরু হয়। কলা ভবনের অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের সামনে থেকে কলা ভবন, শহীদ মিনার, টিএসসি, কার্জন হল হয়ে তারা যায় তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে। এরপর বিকেলে যায় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান ব্রেইনস্টেশন ২৩–এর কার্যালয়ে। সেখানে নিজেদের কাজ ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত নারী কর্মীরা। তাঁদের কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে।
একই দিন সন্ধ্যায় ডরমিটরিতে তাদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল, আইটি উদ্যোক্তা সৈয়দা কামরুন আহমেদ ও বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সভাপতি মুনির হাসান। তাঁরা শিক্ষার্থীদের সারা দিনের গল্প শুনে, তাদের প্রাণশক্তি ও উদ্দীপনা দেখে অভিভূত হন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের কথা শোনেন এবং জানান কীভাবে তারা এই স্বপ্নের পথে এগোতে পারে। এই মুক্ত আলোচনায় বাল্যবিবাহের নেতিবাচক দিকের কথাও উঠে আসে। রূপসার এক শিক্ষার্থী নওরিন জানায়, তাদের এক বন্ধুর বাল্যবিবাহ তারা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় আটকাতে সমর্থ হয়। সেই বন্ধু এখন পুরোদমে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মা–বাবাকে বুঝিয়ে এই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই তারা মনে করে, এই বাল্যবিবাহ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের আরও সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
৮ ফেব্রুয়ারি সকালে তারা সংসদ ভবনের সামনে ইতিহাস ও স্থাপনা সম্পর্কে জানে। এরপর বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে যায়, যেখানে জাদুঘরের দায়িত্বরত কর্মকর্তা পুরো জাদুঘরটি তাদের ঘুরিয়ে দেখান এবং এর বিস্তারিত বর্ণনা করেন। বিকেলে তারা ঘুরে দেখে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর। সেখানে মজার বিজ্ঞান প্রদর্শনশালা, মহাকাশ বিজ্ঞান প্রদর্শনশালা, ইনোভেশন গ্যালারি, বিভিন্ন ল্যাব শিক্ষার্থীদের আলোকিত করে। রূপসা উপজেলার নৈহাটি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ফাতেমা আক্তার শাহনাজের সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ভৌতবিজ্ঞান প্রদর্শনশালা। সে বলে, ‘পাঠ্যবইয়ে আমরা যা পড়েছি, এখানে তার বাস্তবিক প্রয়োগ দেখতে পেরেছি। নিজে হাতে–কলমে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের প্রয়োগ, মাধ্যাকর্ষণ বল, ব্যারোমিটার, কেন্দ্রবিমুখী বল ছাড়া বিভিন্ন বিষয় দেখার পর এগুলো আমার এখন আরও সহজবোধ্য মনে হচ্ছে।’
মেয়েদের সঙ্গে আসা কমরেড রতন সেন বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক স্বপ্না রানী বিশ্বাস বলেন, ‘বাল্যবিবাহের মতো প্রকট সমস্যাযুক্ত একটা এলাকার মেয়েশিক্ষার্থীদের জন্য এমন আয়োজন আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন। এমন আয়োজন ওদের জগৎটাকে প্রসারিত করবে, ওদের চিন্তার পরিধিকে আরও বাড়াবে। আমি মনে করি, বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসতে একটা বড় অবদান রাখতে পারে অবাক কুতুহলে।’
ঢাকা পরিদর্শন শেষে গতকাল রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের কার্যালয় পরিদর্শনের পর ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী দক্ষতা অর্জনের প্রস্তুতি নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নিজ এলাকার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ে শিক্ষার্থীরা। মালালা ফান্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় স্টেম অ্যান্ড আইসিটি স্কিলস ফর দ্য গার্লস অব কোস্টাল এরিয়া (SISGCA) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিডিওএসএনের ‘মিসিংডটার’ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আয়োজিত হয় অবাক কুতুহলে-২০২৫। বিজ্ঞপ্তি