নতুন পাঠ্যবই: গল্প, কবিতা ও ছবিতে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান
পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে মোট আটটি বিষয় স্থান পেয়েছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নতুন পাঠ্যবইয়ে নানাভাবে উঠে এসেছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কথা। গল্প-কবিতা, সংকলন এবং ছবি ও গ্রাফিতির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু।
১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এবার নতুন শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ৪১ জন বিশেষজ্ঞ দিয়ে ৪৪১টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করেছে। এতে অনেক বিষয়বস্তু সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। বেশ কিছু গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা বা বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে স্থান পেয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তুসহ নতুন কিছু গল্প-কবিতা।
এনসিটিবি সূত্রমতে, পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম–দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে মোট আটটি কনটেন্ট বা বিষয় স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া বইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নানা ছবি ও গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে।
এবারের পাঠ্যবইয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ইতিহাসের বইয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকাল পর্যন্ত বিষয় স্থান পেয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু সাহিত্যের অংশ হিসেবে বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে যুক্ত করা হয়েছেঅধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, চেয়ারম্যান, এনসিটিবি
‘আমরা তাঁদের কখনো ভুলব না’
পঞ্চম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ওপর লেখা ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ শীর্ষক একটি লেখা স্থান পেয়েছে। এতে আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ইংরেজদের নির্যাতন থেকে এ দেশের কৃষককে বাঁচাতে গিয়ে যুদ্ধ করে শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর থেকে শুরু করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের কথা স্মরণ করা হয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ ও শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর প্রতিকৃতিও স্থান পেয়েছে লেখায়।
লেখাটিতে ইতিপূর্বে নানা ত্যাগতিতিক্ষার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘এত ত্যাগের পরও এ দেশের মানুষ অধিকার পায় না, বৈষম্য কমে না। অধিকারের দাবি ও বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে এ দেশের শিক্ষার্থীরা তাই ২০২৪ সালে আবার রাস্তায় নামে। সরকারি বাহিনী নির্মমভাবে সেই আন্দোলন দমন করতে চায়। পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রংপুরে ছাত্রনেতা আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান। পুলিশ তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। এতে আন্দোলন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বিশাল এক গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। ঢাকার উত্তরায় শিক্ষার্থী মীর মুগ্ধ আন্দোলনরত সবাইকে পানি বিতরণ করতে করতে নিহত হন। নিহত হন নাফিজ, নাফিসা, আনাসসহ অগণিত প্রাণ। মায়ের কোলের শিশু, বাবার সাথে খেলতে থাকা শিশু, রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, কৃষক, ফেরিওয়ালা, চাকুরিজীবী, মা, পথচারী কেউ বাদ যান না। সারা দেশে হত্যা করা হয় হাজারো মানুষকে। আহত হন অসংখ্য মানুষ। তাঁরা সবাই একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন। সবার অধিকার থাকবে এবং সবাই মিলেমিশে বাস করতে পারবে—এমন একটা দেশের জন্যই তাঁরা শহিদ হয়েছেন। আমরা তাঁদের কখনো ভুলব না।’
কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান
ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠ বইয়ে দুটি গদ্য যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারের ভাষা’ নামে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ওপর লেখা একটি সংকলিত লেখা রয়েছে। এই লেখায় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টারের ছবি যে আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, সেই সব কথা তুলে ধরা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে অসংখ্য গ্রাফিতি আঁকার কথাও আছে এই লেখায়।
কিছু কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও গ্রাফিতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তাই আমাদের মনে রাখতে হবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ শুধু লিখে বা কথা বলে নয়; ছবি এঁকে, গান গেয়ে, এমনকি নৃত্য করেও করা যায়। এ দেশের মানুষ যুগে যুগে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে এমন প্রতিবাদ করেছেন। এসব কার্টুন, ব্যঙ্গচিত্র ও পোস্টার তাই আমাদের ইতিহাসের সম্পদ। এগুলো আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রাখবে, নতুন দিনের নতুন প্রয়োজনে আমাদের নতুনভাবে জাগিয়ে তুলবে।’
নতুন কবিতা সিঁথি, স্থান পেলেন দুই তরুণ র্যাপার
সপ্তম শ্রেণির ‘সপ্তবর্ণা’ বইয়ে হাসান রোবায়েতের লেখা ‘সিঁথি’ নামে একটি কবিতা যুক্ত হয়েছে। এই কবিতা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ওপর লেখা। কবিতাটি এমন, ‘ভাই মরল রংপুরে সেই/ রংপুরই তো বাংলাদেশ/ নুসরাতেরা আগুন দিল/ দোজখ যেন ছড়ায় কেশ।...চিরকালই স্বাধীনতা/ আসে এমন রীতিতে/ কত রক্ত লাইগা আছে/ বাংলাদেশের সিঁথিতে।’
সপ্তম শ্রেণির ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইয়ে আলোচিত দুই তরুণ র্যাপার সেজান ও হান্নানের নাম এসেছে। বইয়ের ‘আ নিউ জেনারেশন’ নামে একটি পাঠে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তাঁদের গানের ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা
অষ্টম শ্রেণির ‘সাহিত্য কণিকা’ বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের ওপর সংকলিত লেখা ‘গণ অভ্যুত্থানের কথা’ স্থান পেয়েছে। এতে উল্লেখ রয়েছে এ দেশের বড় তিনটি গণ-অভ্যুত্থানের কথা। এগুলো হলো উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং ২০২৪ সালে হওয়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থান।
লেখাটিতে গণ-অভ্যুত্থানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বলা হয় ‘মনে রাখতে হবে, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হলেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়ে যায় না। এ জন্য আমাদের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনেক কাজ করতে হবে। সবাইকে পড়াশোনা করে মানুষ হতে হবে। দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। সমাজ থেকে সব ধরনের অন্যায় ও বৈষম্য দূর করতে হবে। একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই ২০২৪–এর শহিদ ও আহতদের আত্মদান সার্থক হবে।’
অষ্টম শ্রেণির ইংলিশ ফর টুডে বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানে নারীর ভূমিকা নিয়ে ‘উইমেনস রোল ইন আপরাইজিং’ শীর্ষক একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। এতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকার কথা রয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নারীদের ছবিও আছে এই অধ্যায়ে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি বহনকারী ভ্যান একজন নারী কীভাবে আটকে দিয়েছিলেন, সেই ছবিও স্থান পেয়েছে। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের কথাও আছে এই অধ্যায়ে।
‘আমাদের নতুন গৌরবগাথা’
নবম-দশম শ্রেণির ‘বাংলা সাহিত্য’ নামের পাঠ্যবইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ওপর লেখা ‘আমাদের নতুন গৌরবগাথা’ নামে একটি সংকলিত প্রবন্ধ যুক্ত হয়েছে। এতে সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের শাসনামলের দুর্নীতি, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট হওয়াসহ নানা অনিয়মের চিত্রও বর্ণনা করা হয়।
অধ্যায়টির শেষের অংশে বলা হয়, ‘প্রকৃতপক্ষে অভ্যুত্থানে বিজয় একটি সুযোগ—সমস্ত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ, নতুনভাবে দেশ গড়ার সুযোগ। অতীতে এমন সুযোগ এ দেশে আরও কয়েকবার এসেছে; কিন্তু আমরা তাকে ব্যবহার করতে পারিনি, ধরে রাখতে পারিনি। এবারের সুযোগকে তাই আমাদের রক্ষা করতে হবে।...আমাদের মনে রাখতে হবে, হাজারো শহিদের আত্মদানে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে। সেই প্রত্যয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ভিন্নমতের প্রতি, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি, ভিন্ন রীতি ও সংস্কৃতির প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানোই গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষা। আর সেই শিক্ষা গ্রহণ করলেই আমাদের নতুন বিজয় সত্যিকারের গৌরবগাথা হয়ে উঠবে।’
নবম-দশম শ্রেণির ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে লেখা ‘গ্রাফিতি’ নামে একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। এর শুরুতে রাজধানীর মেট্রোরেলের পিলারে আঁকা ‘হামাক বেটাক মারলু কেনে?’ শীর্ষক একটি প্রতিবাদী লেখা যুক্ত রয়েছে। শহীদ নূর হোসেনের বুকে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ শীর্ষক ঐতিহাসিক ছবির অনুকরণে আঁকা একটি গ্রাফিতিও রয়েছে এই অধ্যায়ে।
এভাবে নতুন পাঠ্যবইয়ে গল্প-কবিতা, ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নানা বিষয়।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এবারের পাঠ্যবইয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ইতিহাসের বইয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকাল পর্যন্ত বিষয় স্থান পেয়েছে। তাই ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু সাহিত্যের অংশ হিসেবে বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে।