প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা শিক্ষাক্রমের রূপরেখাটি গত ১৩ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর আগে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি একাধিকবার বলেছেন, আমাদের শিক্ষায় বড় পরিবর্তন আসন্ন। সেই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে ২০২২ সালে ১০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে এবং ১০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে চলবে পাইলটিং। পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম; ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হবে বিশ্বস্বীকৃত একমুখী শিক্ষার আওতায় নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি।
২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম; ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হবে বিশ্বস্বীকৃত একমুখী শিক্ষার আওতায় নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রস্তুতকৃত পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম অনুসারে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বার্ষিক বা আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা থাকবে না। তাদের শিখনকালীন তথা শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে মূল্যায়ন করা হবে শতভাগ। নম্বরের পরিবর্তে লেটার গ্রেড বা ওয়ার্ডে প্রদান করা হবে মূল্যমান। থাকবে না শ্রেণি রোল নম্বর, থাকবে না প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় স্থান। প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের জন্য প্রত্যেকের থাকবে পৃথক আইডি নম্বর। নবম ও দশম শ্রেণিতে থাকবে না বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবর্তন করা হবে নতুন আঙ্গিকের বই, আধুনিক শিখনকৌশল ও সার্বিক মূল্যায়নের পদ্ধতি। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাও আসবে এর আওতায়।
প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ ভাগ। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রতি বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নে থাকবে ৬০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকবে ৪০ শতাংশ। অনুরূপভাবে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিখনকালীন মূল্যায়নে থাকবে ৫০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকবে ৫০ শতাংশ। একইভাবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিখনকালীন মূল্যায়নে থাকবে ৩০ শতাংশ এবং সামষ্টিক মূল্যায়নে থাকবে ৭০ শতাংশ।
জানা গেছে, চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত থাকবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। এর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান—এই পাঁচ বিষয়ের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন ধারাবাহিকভাবে শিখনকালে সম্পাদন করা হবে। এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি—এই পাঁচ বিষয়ের ১০০ শতাংশ মূল্যায়নও ধারাবাহিকভাবে শিখনকালে সম্পাদন করবেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, অভিভাবক ও গ্রুপভুক্ত সহপাঠী শিক্ষার্থী। বিভিন্ন কারণে যথাযথ মূল্যায়নে ব্যর্থ হবেন অধিকাংশ অভিভাবক। তাই তাঁদের পক্ষেও মূল্যায়ন করবেন শিক্ষকেরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, উল্লিখিত ১০টি বিষয়ে মোট গ্রেডের স্থলে মোট ১০০০ নম্বর ধরা হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষকের হাতে/নেতৃত্বে মূল্যায়ন ক্ষমতা থাকবে প্রায় ৭৫০ থেকে ৮০০ নম্বরের।
বলা হচ্ছে, শিখনকালীন মূল্যায়ন অনানুষ্ঠানিক ও ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করা হবে। দেখা হবে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, আগ্রহ, আচরণ, অংশগ্রহণ, দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষতা, নৈতিকতা, দূরদর্শিতা ইত্যাদি। বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীর যোগ্যতাভিত্তিক এ মূল্যায়ন শিক্ষক নিজেই সম্পন্ন করবেন। সেই সঙ্গে শিক্ষকের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করবেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর অধিকাংশ অসচেতন অভিভাবক ও গ্রুপভুক্ত সহপাঠী শিক্ষার্থী। শিখনকালীন মূল্যায়ন অবশ্যই একটি উত্তম ব্যবস্থা। তবে আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখনই তা সঠিকভাবে কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষকদের হাতে/নেতৃত্বে যে পরিমাণ মূল্যায়ন প্রদানের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা তাঁরা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হবেন। কেননা, বিভিন্ন কারণে শিক্ষকদের পছন্দ-অপছন্দের প্রভাব পড়তে পারে এর ওপর। কোনো শিক্ষক অনৈতিক হলে এই নম্বরের বিনিময়ে শিক্ষার্থীকে বাধ্য করতে পারেন প্রাইভেট পড়ার বা বাসা–বাড়িতে শিক্ষার নাম করে টাকা প্রদান করার জন্য। এর চেয়েও বড় কথা, পারিপার্শ্বিক দুরবস্থার বিরূপ প্রভাব কমবেশি পড়বেই শিক্ষকদের ওপর।
এনসিটিবি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম অনুসারে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো সামষ্টিক মূল্যায়ন তথা বার্ষিক বা আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা থাকবে না। তাদের শিখনকালীন তথা শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে মূল্যায়ন করা হবে শতভাগ।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির সভাপতি, সদস্য ও স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে পড়লে আদর্শ শিক্ষকেরাও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হবেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা অযোগ্য বা দুর্বল শিক্ষার্থীদেরও পূর্ণ নম্বর দিতে বাধ্য হবেন। অনেক অভিভাবকও অন্যায় চাপ প্রয়োগ করবেন শিক্ষকদের ওপর। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য শক্ত অবস্থান নিতে গেলে শিক্ষকের চাকরি ও জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে যেসব শ্রেণির শিক্ষা মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সরকারি সনদ ও বৃত্তি প্রদান করা হবে, সেসব শ্রেণির শিক্ষকেরা অধিক চাপের সম্মুখীন হবেন এবং কেউ কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় অনৈতিক হবেন নানাবিধ কারণে! শিক্ষা অর্জনের প্রতিযোগিতা রূপ নিতে পারে শিক্ষকের সন্তুষ্টি লাভের প্রতিযোগিতায়।
কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ ও শিক্ষকমণ্ডলী যদি তাঁদের শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিরপেক্ষভাবে করতে সক্ষম হন এবং যদি প্রকৃতভাবে মূল্যায়ন করার ফলে শিক্ষার্থীদের অর্জিত গ্রেড অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের তুলনায় কম হয়, তো সেই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমে যেতে পারে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের অধিক নম্বর বা গ্রেড প্রদান করা হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানে চলে যেতে পারে অনেক শিক্ষার্থী। অর্থাৎ অশুভ প্রতিযোগিতার কারণে অস্তিত্বসংকটে পড়তে পারে আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
অন্যদিকে, শিক্ষকের অনুপাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকায় একজন শিক্ষক অনুকূল পরিবেশ পেলেও এতসংখ্যক শিক্ষার্থীর সবদিক পর্যবেক্ষণে রেখে যথাযথ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হবেন। তীব্রভাবে দেখা দেবে প্রশিক্ষণের অভাব। স্বল্প সময়ে প্রশিক্ষিত করা সম্ভব হবে না বিপুলসংখ্যক শিক্ষক। এ ছাড়া বর্তমানে শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কর্মঘণ্টা শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিধি বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অনুমোদিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের যে পরিমাণ অতিরিক্ত শ্রম, মেধা ও সময়ের প্রয়োজন, সে জন্য শিক্ষকদের যে পরিমাণ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত, তা নেই।
চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত থাকবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। এর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান—এই পাঁচ বিষয়ের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন ধারাবাহিকভাবে শিখনকালে সম্পাদন করা হবে।
এ অবস্থায় শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষকদের কর্তৃত্বে যে অধিক পরিমাণ নম্বর রাখার সিদ্ধান্ত করা হয়েছে, তার পুরোটাই যদি শিক্ষকেরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অযোগ্য শিক্ষার্থীদের দিতে বাধ্য হন বা দেন, তাহলে মূল্যায়ন ব্যবস্থাটি অকার্যকর হয়ে, প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে, মুখ থুবড়ে পড়বে। যেমন ভালোভাবে ব্যবহারিক না করেও শিক্ষকদের খুশি করে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারিক বিষয়গুলোর প্রায় পূর্ণ নম্বর পেয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। এতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ব্যবহারিক শিক্ষার মূল্যায়ন। যদি তেমন হয়, শিখনকালীন মূল্যায়ন তো ব্যাপক ক্ষতির শিকার হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং বিতর্কিত হবে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এই মূল্যায়নব্যবস্থা। এমনকি আটকে যেতে পারে এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন।
তাই শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়নব্যবস্থায় পা রাখার প্রথম কয়েক বছর শিক্ষকদের কর্তৃত্বে এত বেশি পরিমাণ নম্বর বা মূল্যায়ন প্রয়োগের ব্যবস্থা না রেখে; আনুপাতিক হারে আরও অল্প পরিমাণ নম্বর বা মূল্যায়ন প্রয়োগের ব্যবস্থা রাখা উচিত। দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে যথাযথ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা যদি সফলতা দেখাতে পারেন, তাহলে কয়েক বছর পর ধীরে ধীরে শিক্ষকদের কর্তৃত্বে অধিক হারে নম্বর বা মূল্যায়ন প্রয়োগের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। সে জন্য অবশ্যই তৈরি করতে হবে সার্বিক অনুকূল পরিবেশ।
মো. রহমত উল্লাহ: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।