অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানও পাচ্ছে পাঠ্যবই ছাপার কাজ
‘সিন্ডিকেট’ করে কাজ নেওয়ার চেষ্টা, ভিন্ন উপায়ে কাজ পাচ্ছে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ কিছু প্রতিষ্ঠান।
আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু এই কাজ নিয়ে নানা রকমের অভিযোগ উঠেছে। ‘সিন্ডিকেট’ করে কাজ পাওয়ার চেষ্টা যেমন আছে, তেমনি চলতি বছরের বই ছাপায় অনিয়মের অভিযোগ ওঠা একাধিক প্রতিষ্ঠানকেও কাজ দেওয়া হচ্ছে। ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হওয়া কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মালিকানা বদল করে বা একই মালিকের অন্য প্রতিষ্ঠান ছাপার কাজ পাচ্ছে।
এর ফলে সময়মতো মানসম্মত বই দেওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মুদ্রণকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতিও এই ধরনের কিছু বিষয়ে অভিযোগ তুলে গত মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।
অবশ্য এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা আর্থিক বিধিবিধান মেনেই ছাপার কাজ করছেন। আর মুদ্রণ শিল্প সমিতি যেসব অভিযোগ করেছে, সেসব বিষয়ে মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করছে।
জোট বেঁধে কাজ পাওয়ার চেষ্টা
আগামী বছরের জন্য মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২৪ কোটি ৮০ লাখ ৫৯ হাজার এবং প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি ২৫ লাখ বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু করেছে এনসিটিবি। এবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শুধু বই ছাপার জন্য প্রাক্কলিত দর ঠিক করা হয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, বই ছাপার কাজের দরপত্র হয় লটের মাধ্যমে। মাধ্যমিক স্তরে ২৮০টি এবং ২০৮ লটের জন্য আলাদা দরপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু প্রথম দরপত্রের সময় প্রভাবশালী কিছুসংখ্যক মুদ্রণকারী জোট বেঁধে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে গড়ে ২৭ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি দর জমা দিয়ে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করেন। আবার তখন কিছু প্রতিষ্ঠান এই জোটের বাইরে গিয়ে প্রাক্কলিত দরের কাছাকাছি দর দেয়। এই প্রক্রিয়ায় ৫২টি লটের প্রায় পৌনে তিন কোটি বই ছাপার কাজের দরপত্র গ্রহণ করা হলেও বাকি লটগুলোর জন্য পুনঃদরপত্র দেয় এনসিটিবি। পুনঃদরপত্র অনুযায়ী মূল্যায়নের কাজও শেষ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, এবার সব কটি প্রতিষ্ঠান প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ১৮ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দর দিয়েছে।
অন্যদিকে প্রাথমিকের বই ছাপা হবে মোট ৯৮টি লটে। এর মধ্যে ৫২টি লটের দরপত্র প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হলেও বাকিগুলোর জন্য পুনরায় দরপত্র দেওয়া হয়। কারণ, এখানেও অনেকে জোট বেঁধে প্রথমে বেশি দর দিয়েছিল।
‘নিজস্ব মুদ্রণ ব্যবস্থা না থাকায় একশ্রেণির মুদ্রণকারীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এনসিটিবি। তাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া এনসিটিবির উপায় থাকে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে।’নারায়ণ চন্দ্র পাল, সাবেক চেয়ারম্যান, এনসিটিবি
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানও কাজ পাচ্ছে
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বই ছাপার কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাই হওয়া কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চলতি বছরের বই ছাপায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এর মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। আবার কারও কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম প্রমাণিত হলেও ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ রকম প্রতিষ্ঠানও আগামী বছরের বই ছাপার কাজ পাচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত এনসিটিবির স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সভায় কচুয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলা হয়েছিল, তারা চলতি বছরের বই নির্ধারিত সময়ে মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছিল। এতে সরকারের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ জন্য উৎপাদন কমিটি এই প্রতিষ্ঠানটিকে ২০২২ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তকের দরপত্রে অংশগ্রহণে (এক বছরের জন্য) অযোগ্য ঘোষণার সুপারিশ করে। কিন্তু এনসিটিবি সেই সুপারিশ আমলে না নিয়ে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে মুচলেকা সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানটিকে সতর্ক করে দেয়। এখন আগামী বছরের জন্যও এই প্রতিষ্ঠান ছাপার কাজ পাচ্ছে।
এনসিটিবির সূত্রে জানা গেছে, বই ছাপায় অনিয়মের কারণে কালো তালিকাভুক্ত হওয়া টাঙ্গাইল অফসেট প্রেস, মেসার্স রেজা প্রিন্টার্সসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিক্রির মাধ্যমে হাতবদল করে বা কালো তালিকাভুক্ত একই মালিকের ভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ পাচ্ছে। পর্যাপ্ত সক্ষমতা না থাকা প্রতিষ্ঠানকেও বেশি কাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যদিও এনসিটিবি একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কালো তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বিক্রি করা হয় বা ওই ধরনের মালিকের অন্য প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অংশ নিতে বাধা নেই।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দু-একজন মুদ্রণকারীর জন্য যেন পুরো মুদ্রণকারীদের বদনাম না হয়। তাঁরা চান শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো মানসম্মত বই যাক।
বই ছাপায় অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র পাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নিজস্ব মুদ্রণ ব্যবস্থা না থাকায় একশ্রেণির মুদ্রণকারীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এনসিটিবি। তাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া এনসিটিবির উপায় থাকে না। এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে।