বিনিয়োগ বাড়বে, এমন অনুমান প্রশ্নবিদ্ধ
করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব পড়ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগে বড় ধরনের ধাক্কা এসেছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও হারাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত স্বাভাবিক গতিতে আসবে এবং শিগগিরই বেসরকারি বিনিয়োগের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তন হবে। তবে এই ধরনের অনুমান অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যঝুঁকি, সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বিবেচনা করে বলা যায় যে কবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে শুরু হবে, তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের একটি শক্তিশালী প্রত্যাবর্তন নির্ভর করছে আমরা বর্তমান স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে কত দ্রুত মুক্তি পেতে পারি, এর ওপর। এই ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি হলেও তা অপ্রতুল। স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো বিবেচনা করে এই খাতে বর্ধিত বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার প্রয়োজন আছে। কিন্তু বাজেটে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা এবং এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ বাজেট আলোচনা থেকে বাদ পড়েছে।
কোভিড-সংক্রান্ত প্রণোদনা প্যাকেজ সরকার আগেই ঘোষণা করেছে। প্রণোদনা প্যাকেজটি অবশ্য বহুলাংশে ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে পরিচালিত হবে, যদিও ব্যাংকিং খাত নিজেই সংকটে রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের সমস্যার মধ্যে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, খেলাপি ঋণ এবং অনাবশ্যক রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। বাজেটে এমন সংকটের মধ্যে থাকা ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য একটি নির্দেশনা (গাইডলাইন) থাকা উচিত ছিল।
ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে বাজেট ঘাটতির একটি বড় অংশ অর্থায়ন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। এটি একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিতে পারে। সুতরাং, সরকারের উচিত অর্থায়নের বিকল্প পথগুলো খুঁজে বের করা। বিশেষ করে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণের জন্য বাংলাদেশের উচিত জরুরি ভিত্তিতে উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করা।
>বড় দুশ্চিন্তার নাম এখন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। নতুন বাজেট এই সমস্যার সমাধান কতটা করতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আবার বিষয়টি নিয়ে বেসরকারি খাতের ভাবনা জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ। এসব নিয়ে কথা বলেছেন একজন অর্থনীতিবিদ।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দুটি প্রধান চালক হলো রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। বৈশ্বিক অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় ডুবে যাওয়ার শঙ্কায় এই দুটি খাত তীব্র চাপের মধ্যে আছে। বিশেষ করে আমাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকায় দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা আছে। বাজেটে রপ্তানি খাতে যে ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে তৈরি পোশাক খাত বেশি সুবিধা পাবে। অথচ অন্য খাতগুলোও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাজেটে রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে আগের বছরগুলোর মতোই গতানুগতিক বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তাতে বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতির কোনো প্রতিফলন নেই। বাজেটে আগের মতোই যথারীতি চলমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটকে বিবেচনায় না নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের কথা বলা হয়েছে। যদিও পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উত্তরণ তিন বছর পিছিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ, স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উত্তরণ হয়ে গেলে বাংলাদেশ বেশ কিছু বাণিজ্যসুবিধা হারাবে। যেহেতু চলমান অর্থনৈতিক সংকট মধ্যমেয়াদি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি হলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
তেলের দামের অভূতপূর্ব পতনের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকোচন হচ্ছে। এই দেশগুলোতে আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মরত। আমাদের দেশের মানুষেরা ওই সব দেশে চাকরি হারাচ্ছেন। তাই আসন্ন মাসগুলোতে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। একই সঙ্গে এই দেশগুলো থেকে আমাদের বিপুলসংখ্যক প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে আসার শঙ্কাও আছে, যা দেশীয় শ্রমবাজারে একটি বিশাল চাপ ফেলবে। বাজেটে যদিও এই উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে, তা যথেষ্ট স্পষ্ট নয়।
বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে জোরদার এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি করা, কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ দ্রুত শেষ করা এবং আর্থিক খাত (ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজার), কর খাত ও বাণিজ্যনীতির সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই সংস্কারগুলোর বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই।
বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে জোরদার করতে কালোটাকা সাদা করার বিধান অতীতে সফল হয়নি। এটি সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে এবং কর ফাঁকি দিতে উৎসাহ দেয়। বাজেটে এই বিধানটির কোনো সাফল্য দেখার সম্ভাবনা কম।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে কাজ হারাতে থাকা মানুষদের জন্য ‘কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম’ বা ‘বেকার ভাতা’র মতো একধরনের কর্মসূচি থাকা উচিত ছিল। শ্রমবাজারের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য বরাদ্দের বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়।
সেলিম রায়হান
নির্বাহী পরিচালক, সানেম