বেসরকারি ব্যাংক: কর্মীর বেতনে হাত, মালিকের সুবিধায় নয়
করোনার ক্ষতি পোষাতে কর্মীর বেতন কমানোর পথে হাঁটতে শুরু করেছেন বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। অনেকে এরই মধ্যে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। করোনাকালে ব্যাংকের কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিয়েছেন। তাঁরাই এখন চাকরি হারানো ও বেতন কমে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগছেন। এ নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বেসরকারি খাতের দেশীয় মালিকানাধীন এবি, দি সিটি ও এক্সিম ব্যাংক এরই মধ্যে কর্মীদের বেতন ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোও কয়েক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানা যাচ্ছে। বতর্মানে দেশে ৪২টি বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে।
এদিকে ব্যাংকারদের বেতন-ভাতা কমলেও কমেনি ব্যাংক পরিচালকদের সভায় অংশগ্রহণের ফি ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা। দু–একটি ব্যাংক যখন নিজেরাই বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন বেসরকারি সব ব্যাংকারের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করেছে ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) একটি চিঠি।
বিএবির ওই চিঠিতে ব্যাংকারদের নানা সুবিধা বন্ধের পাশাপাশি ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতনধারীদের ১৫ শতাংশ করে বেতন কমানোর কথা বলা হয়েছে। সব ব্যাংক যাতে আগামী ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে, সেই পরামর্শ দিয়েছে বিএবি।
পাশাপাশি বিএবির চিঠিতে কর্মীদের পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, প্রণোদনা বোনাস বন্ধ, নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপশাখা খোলা বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। ১৩ দফা সুপারিশ–সংবলিত চিঠিতে আরও রয়েছে সব ধরনের স্থায়ী সম্পদ ও আইটি পণ্য ক্রয় বন্ধ রাখা, কর্মীদের স্থানীয় ও বিদেশি প্রশিক্ষণ বন্ধ রাখা, সব বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখা, সব ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা খরচ ও অনুদান বন্ধ রাখা, পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রদান বন্ধ রাখা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকার বলেন, বাসাভাড়াসহ অন্য কোনো খরচই কমেনি। ফলে হঠাৎ করে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কমানো হলে তাতে ব্যাংকাররা বিপদে পড়ে যাবেন। চাইলেই হুট করে বাসাবদল, বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ, জীবনযাত্রা ব্যয় কমানো যায় না। মালিকেরা বছরের পর বছর মুনাফা নিয়েছেন। করোনার মধ্যেও কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, তার বিনিময়ে এখন বেতন–ভাতা কমানোর সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কর্মীদের বেতন কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত মালিকেরা সব ধরনের সুবিধা ভোগ করছেন। বেনামেও নানা সুবিধা নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের আয় কমে গেছে, এ জন্য টিকে থাকতে ১৫ শতাংশ বেতন কমানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্যাংকগুলো নিজেরাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের এক্সিম ব্যাংক ১৫ শতাংশ বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৪০ হাজার টাকার কম বেতন যাঁরা পান, তাঁদের কারও বেতন কমবে না।’
কর্মীদের বেতন কমাচ্ছেন, কিন্তু নিজেদের সুবিধা কমাচ্ছেন না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘পষর্দের সভা করে আমরা যে ফি নিই, তা নেব না। পরিচালকদের পেছনে যে খরচ হয়, তা–ও বন্ধ করা হবে। একজন ব্যাংকারের সর্বোচ্চ বেতন কত হবে, তা নির্ধারণ নিয়েও আলোচনা চলছে।’
>ক্ষতি পোষাতে এরই মধ্যে বেতন কমিয়েছে এবি, সিটি ও এক্সিম ব্যাংক। বাকিগুলো কমানোর পথে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলো কোনোভাবেই বেতন কমাতে পারে না। বাহুল্য খরচ কমিয়ে তাদের ব্যয় সমন্বয় করতে হবে। খুব বেশি হলে তারা বোনাস বা ভাতা কমাতে পারে। আগামী দুই বছরে মুনাফা না করে শুধু খরচ মেটানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ব্যাংক খাত বেতন কমানো ও ছাঁটাই শুরু করলে পুরো বেসরকারি খাতে এ প্রবণতা শুরু হবে। এতে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে। তাই এখনই এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ দরকার।
গত এপ্রিল থেকে সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর করার পর থেকে ব্যাংকগুলোর আয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনার হানা। কম সুদ ও করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ব্যাংকের রিটেইল ঋণের ব্যবসা। এ কারণে খুচরা ঋণ বিভাগের লোকবল কমিয়ে খরচ কমানোর চেষ্টা করছে অনেক ব্যাংক।
ব্যাংকাররা বলছেন, অনেক ব্যাংক পরিচালকের নিজস্ব ভবনে চড়া ভাড়ায় ব্যাংকের অনেক শাখা রয়েছে। সেসব ভাড়া সমন্বয় করলে ব্যাংকের অনেক খরচ বেঁচে যাবে। আবার পরিচালকদের কাছে নামে–বেনামে ব্যাংকের অনেক টাকা আটকে আছে, সেগুলো ফেরত আনা গেলে ব্যাংকের কোনো লোকসানই হবে না।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বিএবি কর্মীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এটা ব্যাংকগুলোর নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়। তিনি এ–ও বলেন, এ বছর ব্যাংকগুলোর মুনাফা করা কঠিন হবে। তবে কর্মীদের অবদানের কথা ভেবে বিষয়টা মানবিকভাবে দেখা উচিত।