ব্যবসায় ভাটার টান, কমেছে বিক্রি
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে এত দিন যে সুসময় ছিল, তা হঠাৎ করে যেন অনেকটা উধাও হয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারভিত্তিক বিভিন্ন খাত ও বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা পণ্য বিক্রিতে ভাটার টান দেখছে, যা সাম্প্রতিক কালে নজিরবিহীন।
সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে কোনো কোনো খাতে পণ্য বিক্রি কমে গেছে। কোনো খাতে বিক্রিতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও হার কমেছে। রপ্তানি আয়ে কমতির ধারা সরকারি হিসাবেই দৃশ্যমান।
বিক্রি যে কমছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত সিমেন্ট, ইস্পাত, জুতা ও চামড়াজাত পণ্য, নিত্যব্যবহার্য এবং ভোগ্যপণ্য খাতের ১৭টি নেতৃস্থানীয় কোম্পানির তথ্যে। কোম্পানিগুলোর গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে ১০টি পণ্য বিক্রি কমেছে। তিনটির প্রবৃদ্ধি আছে, তবে খুবই নগণ্য। অবশ্য চারটি ভালো করেছে।
পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয় অথবা ঘোষিত হালনাগাদ তথ্য নেই—এমন নেতৃস্থানীয় আরও ১০টি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা কোনো প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছেন না। থাকলেও সেটা স্বাভাবিক প্রবণতার চেয়ে কম।
বিগত বেশ কয়েক বছর বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো ব্যবসায় ভালো করছিল। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। হঠাৎ করে বিক্রি কমে যাওয়া কোম্পানিগুলোর কাছে নতুন প্রবণতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বড় কোম্পানির বিপণন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য বিক্রিতে এখনকার যে ধারা, তা বহু বছরে দেখা যায়নি। বিশেষ করে একটু উচ্চমূল্যের পণ্য বিক্রি কমেছে (ওই কোম্পানির পণ্যতালিকায় থাকা)। যেমন গুঁড়া দুধ ও ভোজ্যতেল। এর মানে হলো, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম।
আরেকটি কোম্পানির বিপণন বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তি বলেন, বিস্কুটের ছোট প্যাকেটের বিক্রি ভালো। ফ্যামিলি প্যাকের বিক্রি কম। এটাও বুঝিয়ে দেয় যে সীমিত ও মধ্য আয়ের পরিবারগুলো চাপে আছে।
কোন ক্ষেত্রে বিক্রি কম
খুচরা পণ্য বিক্রিতে কী দশা, তার পরিসংখ্যান বিভিন্ন দেশ নিয়মিত ভিত্তিতে প্রকাশ করে। যেমন জাপান গত মাসে জানিয়েছে, অক্টোবরে তাদের খুচরা বিক্রি ৭ শতাংশের মতো কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ ধরনের কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করে না। পণ্য বিক্রির প্রবণতা বুঝতে পুঁজিবাজারে কোম্পানির দেওয়া তথ্য, বেসরকারি বাজার জরিপ ও নাম গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে কোম্পানির দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত সিমেন্ট খাতের ছয়টি কোম্পানির সম্মিলিত বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা, আগের বছরের চেয়ে ১ শতাংশ কম। অথচ অনেক বছর ধরেই সিমেন্ট খাত দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। ইস্পাত খাতে আরও করুণ দশা। এ খাতের চারটি কোম্পানির মোট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ কম।
ইস্পাত খাতের বিক্রি কমে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাজেটের পর ইস্পাতের খুচরা বিক্রি বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। কারণ, খুচরা পর্যায়ের টনপ্রতি ভ্যাট ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩০০ টাকা হয়েছিল। পরে সেটি ৫০০ টাকায় নামিয়ে আনলেও ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা ফেরেনি।
জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের বাজারের দুই শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাটা ও অ্যাপেক্সের বিক্রি কমেছে। অ্যাপেক্স অবশ্য শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর নয়। নিত্যব্যবহার্য, কৃষিযন্ত্র, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য বিপণনকারী এসিআইয়ের বিক্রির প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ শতাংশ। কাগজ, টিস্যু ও ডায়াপার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা পেপার মিলসের বিক্রি কমেছে।
সার্বিক অর্থনীতির প্রবণতার একটি ধারণা পাওয়া যায় সুগন্ধি সাবান বিক্রির প্রবৃদ্ধি দেখে। গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কৃষি যন্ত্রপাতির বিক্রি দেখে। এই দুই ক্ষেত্রেই ভালো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
>বেশ কয়েক বছর বড় শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবসা ভালো চলছিল। হঠাৎ বিক্রি কমে যাওয়ার প্রবণতা।
একটি বহুজাতিক বাজার জরিপকারী প্রতিষ্ঠান নিয়মিত সাবানের বাজার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের জরিপ প্রতিবেদন বলছে, অক্টোবর পর্যন্ত ১২ মাসে দেশে সুগন্ধি সাবান বিক্রি হয়েছে ৭৭ হাজার ৮৬০ টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২ মাসে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল বলে জানায় ওই প্রতিষ্ঠানের আরেকটি জরিপ।
কৃষিযন্ত্রের মধ্যে ট্রাক্টরের বাজারই সবচেয়ে বড়। একটি কোম্পানির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরের ১১ মাসে দেশে ট্রাক্টর বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৫৬৫টি, যা আগে বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ কম।
আসবাব বিপণনকারী একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তাদের বিক্রি ৫ শতাংশ কমেছে। যদিও তারা এ বছর ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছিল। মুঠোফোন বিক্রেতা একটি প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের প্রধানও বিক্রি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কথা বলেছেন। পোশাক বিক্রেতা কয়েকটি ব্র্যান্ড বলেছে, শপিং মলে এখন ক্রেতা খুবই কম।
লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা মোটরসাইকেল বিক্রিতেও ততটা গতি নেই। ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল বিক্রিতে প্রায় ২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। চলতি বছরের ১১ মাসে সেটা সাড়ে ১৬ শতাংশ নেমেছে। উত্তরবঙ্গে মোটরসাইকেল বিক্রি অনেক কম উল্লেখ করে একটি কোম্পানির বিপণনপ্রধান বলেন, ধানের দাম ভালো থাকলে সেখানে বিক্রি বেশি হতো।
কারণ কী কী
কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে আলাপ করে পণ্য বিক্রিতে ভাটার টান তৈরি হওয়ার বেশ কিছু কারণ জানা যায়। সাধারণ একটি কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, দেশের মানুষের বড় অংশের কাছে বাড়তি খরচ করার মতো টাকা নেই। যাঁরা বড় অঙ্কের অর্থের মালিক, তাঁরা এখন খরচ করতে সতর্ক। দ্বিতীয় বড় কারণ হিসেবে উঠে আসছে করের চাপ। নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন বাস্তবায়নের কারণে মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দেওয়া নিয়ে বিপাকে রয়েছেন।
তৃতীয় কারণটি হলো, গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য নেই। ধানসহ কয়েকটি প্রধান ফসলের ভালো দাম পাননি চাষিরা। এতে তাঁদের কৃষি যন্ত্রপাতি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য কেনার সক্ষমতা কমেছে।
চতুর্থ কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, চাকরিজীবীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে বাড়তি কিছু আয় পেতেন। সেটা এখন নেই। সঞ্চয়পত্রে নির্ভরশীল পরিবারের আয় কমেছে করের কারণে। ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণ নিয়ে কেনাকাটায়ও আগ্রহী নয় মানুষ।
এর বাইরে খাতভিত্তিক বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের মাস নভেম্বরে মোটরসাইকেল বিক্রি ৩০ শতাংশ কমেছে। সিলেট অঞ্চলে পাথরের বাণিজ্যে মন্দা বলে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য কম। দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের কারণে ভোগ্যপণ্যে মানুষের ব্যয় করার ক্ষমতা কমেছে।
কেউ কেউ মনে করেন, বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ ভোক্তার আস্থায় চিড়। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, সামগ্রিক অর্থনীতি সম্পর্কে ভোক্তা যদি আস্থাশীল হয়, তাহলে বাড়তি ব্যয় করে। আবার আস্থায় চিড় ধরলে ব্যয় কমিয়ে দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষ দেখছে, আশপাশে প্রচুর শিক্ষিত বেকার। পোশাক কারখানায় ছাঁটাই হচ্ছে। বেসরকারি খাতে চাকরিজীবীরা চাপের মধ্যে রয়েছেন। ছোট ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই। পণ্যমূল্যও বাড়ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ী, কৃষক, চাকরিজীবীরাই বাজারে গিয়ে ক্রেতায় পরিণত হন। তাঁরা যদি ভালো না থাকেন, তাহলে পণ্য কেনাবেচা কমবেই। তিনি বলেন, অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ যদি ব্যাংকে থাকে, তাহলে আমানত বাড়ে। ঋণের সুদের হার কমে। বিনিয়োগ হয়। কর্মসংস্থান হয়। টাকা যদি বিদেশে চলে যায় অথবা ঘরের সিন্দুকে থাকে, তাহলে সেটা কোনো ভূমিকাই রাখে না।
উদ্বেগ নেই
পণ্য বিক্রিতে ভাটার মানে হলো অর্থনীতিতে মন্দা। বাজারে চাহিদা কমলে উৎপাদন কমবে, উৎপাদন কমলে বিনিয়োগ কমবে এবং বিনিয়োগ কমলে বেকারত্ব বাড়বে।
সামগ্রিক অর্থনৈতিক এ পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি মহলে উদ্বেগ ও পদক্ষেপ দেখছেন কি না—জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘অর্থনীতির অনেক কিছু নির্ভর করে আর্থিক খাতের ওপর। সেখানে অবস্থা ভালো নয়। সেটি ঠিক করতে শক্ত পদক্ষেপ তো আমরা দেখছি না।’