ইত্তিহাদে গার্দিওলা-দর্শন

ইত্তিহাদ স্টেডিয়াম। ছবি: লেখক
ইত্তিহাদ স্টেডিয়াম। ছবি: লেখক

‘Some are born here; some are drawn here, but we call it home.’ ম্যানচেস্টার সিটির নতুন ঠিকানা ইত্তিহাদ স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়দের বসার জায়গার ঠিক ওপরে নীলচে আভায় গোলাকৃতি ফুটবলসদৃশ দেয়ালে আবেগঘন এ কথা লেখা আছে। টনি ওয়ালশের বিখ্যাত কবিতা ‘Longfella’–র আবেগঘন চরণটি ক্লাবের অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছবি সযত্নে ধারণ করে চলেছে।

২০১৭ সালের ২২ মে ম্যানচেস্টার শহরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত ২২ জনের স্মরণে কবি টনি ওয়ালশ এই কবিতা লিখেছিলেন।

১৮৯৪ সালে ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের গোড়াপত্তন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এগিয়ে চলা ক্লাবটি এই একুশ শতকের শুরুতেও বলতে গেলে একেবারে দেনার দায়ে ডুবে ছিল। ২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফুটবলপাগল ধনকুবের শেখ মনসুর ম্যানচেস্টার সিটির বেশির ভাগ শেয়ার কিনে অঢেল বিনিয়োগ করে ক্লাবের পুরো পরিকাঠামো ঢেলে সাজানো শুরু করেন। ক্লাবের মালিকানা বদলের পর ম্যান সিটি তাদের ঠিকানাও বদল করে ফেলেছে। তাদের বর্তমান নিবাসভূমির নাম ইত্তিহাদ স্টেডিয়াম। তবে স্টেডিয়ামকে ঘিরে গড়ে ওঠা ক্লাবের যাবতীয় পরিকাঠামোকে একসঙ্গে বোঝাতে বলা হয় ‘ইত্তিহাদ ক্যাম্পাস’।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার চমৎকার মিশেলে গড়ে ওঠা ফুটবল মহানগরী ম্যানচেস্টার। ম্যানচেস্টার শহরের মধ্যে অবস্থিত সবচেয়ে বড় ট্রামস্টেশন Piccadily থেকে কয়েক মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে পৃথিবী বিখ্যাত দুটো বড় ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি শহরটাকে পৃথিবীর তাবৎ ফুটবলপ্রেমীর কাছে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ম্যানচেস্টার শহরের মোট লোকসংখ্যা ৫ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। ভাবুন তো, কোনো এক সুপার সানডের কথা। দুই ক্লাবেই সন্ধ্যাবেলায় দুটো বড় ম্যাচ চলছে। ম্যানইউয়ের মাঠে রেড ডেভিলদের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন ৮৮ হাজার লাল সমর্থক, ওদিকে সিটিজেনদের হয়ে গলা ফাটিয়ে চলেছেন ৫৫ হাজার নীল জার্সিধারী। সব মিলিয়ে ওই ৯০ মিনিটে শহরের ৫ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মধ্যে ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ ফুটবল মাঠে গলা ফাটিয়ে চলেছেন তাঁদের নিজের দলের হয়ে। অন্যদিকে মাঠের বাইরে ফ্যান পার্ক, পাব, বার মিলিয়ে আরও লক্ষাধিক মানুষ ফুটবলের আনন্দযজ্ঞে সামিল হয়েছেন। সব মিলিয়ে একটা শহরের অর্ধেক মানুষ মাঠে এবং মাঠের বাইরে ফুটবল উন্মাদনায় বুঁদ হয়ে আছেন, যা এককথায় অবিশ্বাস্য।

স্বপ্নপূরণের লেখক। ছবি: সংগৃহীত
স্বপ্নপূরণের লেখক। ছবি: সংগৃহীত

যাইহোক, Piccadily থেকে সাড়ে তিন পাউন্ড দিয়ে ডে টিকিট কেটে ইত্তিহাদ ক্যাম্পাসের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সিটি সেন্টার পেরিয়ে কয়েক মিনিটের যাত্রা শেষে ইত্তিহাদ ক্যাম্পাসে এসে ট্রাম থামল। যাত্রাপথে আধুনিক কিছু স্থাপনার পাশাপাশি পুরোনো স্থাপনা চোখে পড়ল, যেগুলো সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ইংল্যান্ডে আসার পর যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অবাক করে আমাকে, সেটি হলো ঐতিহ্যকে পরম মমতায় সংরক্ষণ করা। এদের প্রতিটি শহরে দু-তিনটি করে মিউজিয়াম পাবেন, যেখানে শহরের পুরোনো ঐতিহ্যগুলোকে সযত্নে রাখা আছে। আপনি একটি পুরোনো বাড়ি ভাঙতে গেলে আপনাকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। ওরা ওই বাড়ির কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে কি না, সেটি যাচাইয়ের পর অনুমতি দিলে তারপর আপনি বাড়ি ভাঙার অনুমতি পাবেন।

ট্রাম থেকে নামতেই ২ ডিগ্রি তাপমাত্রার রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া ইত্তিহাদ ক্যাম্পাসে স্বাগত জানাল। ট্রামস্টেশন থেকে চমৎকার বাঁধানো সিঁড়ি ডিঙিয়ে ওপরে উঠতেই অনিন্দ্যসুন্দর ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখে রাখা ফুটবলসদৃশ ছাতার নিচে আয়তাকার নীল অভিবাদন বোর্ডের দিকে তাকাতেই আপনি দেখতে পাবেন, ‘WELCOME TO MANCHESTER CITY’.

টিকিট ২০ পাউন্ড
২০ পাউন্ড (স্টুডেন্ট ২০ পাউন্ড, অন্যদের ২৭ পাউন্ড) দিয়ে টিকিট কেটে এবার গাইডের জন্য অপেক্ষা। আমরা গ্রুপে ৩০ জনের মতো ছিলাম। প্রত্যেকের হাতে একটি করে ডিভাইস এবং এয়ারফোন দেওয়া হলো। দুজন ট্যুর অপারেটর আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ৩৬০ ডিগ্রি রুমে নিয়ে গেলেন। রুমে ঢুকে ডিভাইস অন করে এয়ারফোন অন করতেই কর্ণকুহরে ভেসে এল সমর্থকদের সেই চিরচেনা গমগমে আওয়াজ। অন্যদিকে দেয়ালে চোখ রাখতেই ৩৬০ ডিগ্রির পর্দায় ভেসে ওঠা দৃশ্যপট আমাদের টাইম মেশিনে করে নিয়ে গেল ম্যান সিটির ইতিহাসের কানাগলিতে। কয়েক মিনিটের অডিও ভিজ্যুয়ালের ভেলায় চড়ে আমরা ম্যানসিটির অতীত ও বর্তমানের গৌরবগাথার সাক্ষী হলাম। ইতিহাসের গোলকধাঁধা পেরিয়ে এবার চলে গেলাম ইত্তিহাদ ক্যাম্পাসের ফ্যান পার্কে। ম্যাচ ডে-তে ফ্যান পার্কের উন্মাদনা অনুভব করতে আমাদের গাইড এয়ারফোন অন করতে বলল। এয়ারফোন অন করতেই কানে ভেসে এল সেই চিরচেনা গমগমে আওয়াজ, সমবেত ফুটবল সংগীতের সুরধ্বনি।

ইত্তিহাদ স্টেডিয়ামের মূল ফটকের সামনের দিকটা খুব পরিপাটি করে সাজানো। চারদিকে নীলের আভা, তার মধ্যে দেয়ালজুড়ে ম্যানসিটির খেলোয়াড়দের বিজয়গাথার ছবি টাঙানো। ম্যাচের দিন স্বাগতিক দলের খেলোয়াড় বহনকারী বাস এসে মূল ফটকের সামনের ফাঁকা জায়গায় পার্ক করে। সমর্থকেরা মাঝখানে খেলোয়াড়দের জন্য তৈরি নিরাপত্তাবেষ্টনীর দুই পাশে তাঁদের ভালোবাসার বরণডালা নিয়ে হাজির হন। প্রবল হর্ষধ্বনির সঙ্গে তুমুল করতালির বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে খেলোয়াড়েরা ড্রেসিংরুমের দিকে যাত্রা শুরু করেন। অন্যদিকে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের সুড়ঙ্গপথ দিয়ে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেও সেই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। স্বাগতিক দল সমর্থকদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাঠে প্রবেশ করে, আর বিপক্ষ দল সুড়ঙ্গপথ ধরে যেন এক অচিনপুরীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।

জিমে বিজয়ের মুহূর্তগুলো আঁকা
ইত্তিহাদের প্রবেশমুখ পেরোতেই চমৎকারভাবে গোছানো পরিপাটি অভ্যর্থনাকক্ষ। এই কক্ষ পেরিয়ে কিছুটা সামনে যেতেই পরপর দুটো ড্রেসিংরুম। ড্রেসিংরুমে প্রবেশের পূর্বেই সাজানো-গোছানো পরিপাটি এক জিমের দেখা মেলে। ম্যাচ শুরুর পূর্বে অথবা ম্যাচের মধ্যবিরতিতে খেলোয়াড়েরা এখানে হালকা জিম করে নিতে পারেন। ম্যাচের মধ্যবিরতিতে জিমের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রিতে রাখা হয়, যাতে করে খেলোয়াড়েরা শরীরের ঘাম দ্রুত শুকিয়ে ফ্রেশ হতে পারেন। জিমের চারপাশের দেয়ালজুড়ে খেলোয়াড়দের বিজয়োল্লাসের মুহূর্তগুলো চমৎকারভাবে বাঁধিয়ে রাখা। এটাও মনস্তাত্ত্বিক খেলার অংশ। পেপ গার্দিওলার ভাষায়, Extra 1% psychological impact. জিমে বসে খেলোয়াড়েরা যেদিকে তাকাবেন, সেদিকেই তাঁদের গর্বিত বিজয়ী মুহূর্তগুলোকে অনুভব করতে পারবেন, যেটি তাঁদের মননে নেতিবাচক ভাবনাকে দূরে সরিয়ে বিজয়ের ইতিবাচক আকাঙ্ক্ষাকে প্রজ্বলিত করে।

এখানেই দর্শকেরা মেতে ওঠেন আগুয়েরো আর জেজুসদের খেলায়। ছবি: লেখক
এখানেই দর্শকেরা মেতে ওঠেন আগুয়েরো আর জেজুসদের খেলায়। ছবি: লেখক

ড্রেসিংরুম সাদামাটা
জিম পেরিয়ে প্রথমে বিপক্ষ দলের ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করলাম, যেটি সাদামাটা মনে হলো। এরপর আমাদের গাইড ম্যানসিটির ড্রেসিংরুমে নিয়ে গেল, যার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে পেপ গার্দিওলার ফুটবল রুচির মিষ্টি আভা। দরজা পেরিয়ে গোলাকৃতির ড্রেসিংরুমে ঢুকলেই প্রথমে চোখে পড়বে গার্দিওলার Strategic Display Board, বোর্ডের গায়ে লেপ্টে থাকা চুম্বকীয় ঘুঁটি, যেটি মুভ করে খেলার আগে এবং মধ্যবিরতিতে খেলোয়াড়দের কৌশল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বোর্ডের ঠিক ওপরেই বড় আকারের টিভি স্ক্রিন, যেখানে প্রয়োজনীয় ফুটেজগুলো দেখানো হয়। খেলোয়াড়দের চেয়ারগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। চেয়ারের ওপর প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নাম ও নম্বরনামাঙ্কিত জার্সি ঝুলছে। চেয়ারের সঙ্গে পেছনে একটি করে ড্রয়ার, যেখানে খেলোয়াড়েরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখতে পারে। ড্রয়ারের দরজায় যেন একজন আরেকজনের সঙ্গে আড়াল না হয়ে যান, তার জন্য ড্রয়ারের দরজা ভেতরে প্লেস করার ব্যবস্থা আছে। ড্রেসিংরুমজুড়েও নীলের ছোঁয়া এবং ড্রেসিংরুম গোলাকৃতির শেপে আনার কারণ হলো কোচ যখন কথা বলবেন, তখন যেন সবার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা।

ক্লাবে বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড় থাকেন, সবাই ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে উঠে আসা। ফলে তাঁদের মধ্যে যেন ভালো পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে ওঠে, সে জন্য একই দেশের খেলোয়াড়দের সাধারণত পাশাপাশি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয় না। একটাই ব্যতিক্রম চোখে পড়ল। আর্জেন্টিনার দুই খেলোয়াড় সার্জিও আগুয়েরো এবং ওটামেন্ডির চেয়ার দুটি পাশাপাশি চোখে পড়ল। সুযোগ পেয়ে গ্যাব্রিয়েল জেজুস এবং সার্জিও আগুয়েরোর চেয়ারে বসে একটু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফ্লেভার নিলাম। ম্যাচের আগে এবং ম্যাচের মধ্যবিরতিতে গার্দিওলা কীভাবে খেলোয়াড়দের তাঁর কৌশল বুঝিয়ে দেন, মানসিকভাবে উজ্জীবিত করেন, তার একটি অডিও ভিজ্যুয়াল দেখানো হলো; যেখানে গার্দিওলা আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষায় উত্তেজিত ভঙ্গিতে খেলোয়াড়দের বলছেন, ‘You always keep in mind, I am the boss!’

ড্রেসিংরুমের সিঁড়িতেও গার্দিওলা

খেলা শুরুর আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দুই দল এক জায়গায় মিলিত হয়। এই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় খেয়াল করলাম, দেয়ালের দুই পাশে ম্যানসিটির প্রত্যেক খেলোয়াড়ের প্রিয়জনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি টাঙানো আছে। কারও মা, কারও প্রিয়তমা, আবার কারও সন্তানের প্রিয় মুখ সেখানে আলো ছড়িয়ে চলেছে। এটাও পেপের নিজস্ব ফুটবলদর্শনের অংশ। সেই Extra 1% psychological impact. অর্থাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে নামার পূর্বে প্রিয় মানুষের প্রতিচ্ছবি তাঁদের মনে এক ধরনের ইতিবাচক উদ্দীপনার জন্ম দেয়, যেটি মানসিক চাপ কমিয়ে মাঠে নেমে শতভাগ উজাড় করে দিতে সহায়তা করে।

সিঁড়ির কোনায় গার্দিওলার অফিসকক্ষ। গার্দিওলার দুটো অফিস আছে, একটি একাডেমিতে, আরেকটি স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়ামের অফিসকক্ষে গার্দিওলার গুরু বার্সেলোনার সাবেক সফল কোচ লা মেসিয়ার উদ্ভাবক ইউহান ক্রুইফের ছবি টাঙিয়ে রেখেছেন। যাঁর ফুটবল দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে গার্দিওলা টিকিটাকার পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন। বার্সেলোনাতে মেসি-ইনিয়েস্তা-জাভি-আলভেজদের পায়ে অন্য গ্রহের জাদুর ফুটবলের পসরা সাজিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়-মন জয় করেছিলেন। খেলা শেষে বিপক্ষ দলের ম্যানেজারকে নিজের অফিসকক্ষে নিমন্ত্রণ করে একসঙ্গে গলা ভেজান এবং ওই সময়টুকু কৌশল, প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ ভুলে নিখাদ ফুটবল আড্ডায় মেতে ওঠেন।

ম্যানচেস্টার সিটির এই স্টেডিয়াম ২০ পাউন্ডের বিনিময়ে ঘুরে দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত
ম্যানচেস্টার সিটির এই স্টেডিয়াম ২০ পাউন্ডের বিনিময়ে ঘুরে দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই আমাদের গাইড দর্শনার্থীদের দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়াতে বলল, ঠিক যেভাবে ম্যাচ শুরুর পূর্বে দুই দলের খেলোয়াড়েরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। আমি সিটি ফ্যান হিসেবে পরিচয় দেওয়ায় গাইড আমাকে সিটির অধিনায়ক হিসেবে সবার সামনে বাঁ পাশের সারিতে দাঁড়াতে বলল। আমার ডান পাশে বিপক্ষ দলের অধিনায়ক। ম্যাচ ডের মতো নিয়ম করে আমাদের দুই অধিনায়ককে হাত মেলাতে বললেন। আমি হাসিমুখে হাত মেলাতেই গাইড বলল, হাসিমুখ থাকলে চলবে না, দুজনের চেহারায় একটা শত্রু শত্রু ভাব আনতে হবে, যাতে করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ পাওয়া যায়। অগত্যা গম্ভীর মুখে হাত মেলালাম।

টানেলের দামি কার্পেটের ওপর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে চলেছি। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আমি যেন ম্যানসিটির অধিনায়ক ভিনসেন্ট কোম্পানি। আর আমার পেছনে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছে সার্জিও আগুয়েরো, গ্যাব্রিয়েল জেজুস, কেভিন ডি ব্রুইনা, ওটামেন্ডি, রাহিম স্টারলিং, ডেভিড সিলভা প্রমুখ। আর গাইড হিসেবে আমার সঙ্গে আছেন খোদ গার্দিওলা! কর্ণকুহরে বেজে চলেছে ইংলিশ দর্শকদের সেই গমগমে আওয়াজের প্রতিধ্বনি, যা সত্যিকারের ম্যাচের দিনের অনুভূতি এনে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, ইত্তিহাদের ৫৫ হাজার ক্রেজি ফুটবল ফ্যান নেচে-গেয়ে তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে ৯০ মিনিটের জন্য আমাদের ১২০ ও ৮০ গজের সবুজ গালিচায় অভ্যর্থনা জানাতে ভালবাসার বরণডালা সাজিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

করিডোর পেরিয়ে কর্ণকুহরে ভেসে আসা তুমুল করতালির বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে ইত্তিহাদের সবুজ গালিচার সামনে গিয়ে হাজির হলাম। সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি, ভাষার দীনতা সেই অনুভূতি প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্যালারির প্রতিটি চেয়ার থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামের পরতে পরতে লেগে আছে নীলের ছোঁয়া। মাঠে চোখ ফেরাতেই মনে হলো বিস্তীর্ণ নীল প্রান্তরের মধ্যে যেন এক টুকরো আয়তাকার সবুজ দ্বীপ। যে দ্বীপ ফুটবল নামক এক জাদুর গোলকের ছোঁয়ায় প্রতিটি মুহূর্ত রাঙিয়ে দিয়ে জীবনের জয়গান গাইতে সদা উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে।

মাঠে ৯৭ ভাগ প্রাকৃতিক ঘাস, ৩ ভাগ কৃত্রিম ঘাস
উজ্জ্বল সবুজ গালিচা দেখে এত দিন ভাবতাম, এটি বোধহয় কৃত্রিম ঘাসের তৈরি। কিন্তু সঙ্গে থাকা গাইডকে জিজ্ঞেস করতেই এত দিনের প্রচলিত ভুল ভাঙল। গাইড জানাল, এই মাঠ তৈরিতে ৯৭ শতাংশ প্রাকৃতিক ঘাস এবং ৩ শতাংশ কৃত্রিম ঘাস ব্যবহার করা হয়েছে। বেলজিয়ামে উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ৯৭ শতাংশ প্রাকৃতিক ঘাসের মধ্যে ৩ শতাংশ কৃত্রিম ঘাস এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়, যেন ঘাসগুলো সব সময় খাড়া থাকে এবং নুইয়ে না পড়ে। মাঠে দেখলাম, দুটি অতি বড় আকৃতির কৃত্রিম বাল্ব সূর্যের মতো আলো ছড়িয়ে চলেছে। এত বড় বাল্ব আগে কখনো দেখিনি। খোঁজ নিতে জানা গেল, ইংল্যান্ডের আবহাওয়া সাধারণত রৌদ্রোজ্জ্বল নয়। সারাক্ষণ মেঘলা আকাশ এবং বৃষ্টি লেগে থাকে, তাই ঘাসগুলোকে সজীব ও সতেজ রাখতেই এই কৃত্রিম সূর্যালোকের ব্যবস্থা।

ইত্তিহাদের ভিআইপি বক্স মূল গ্যালারির সঙ্গেই। তবে বাড়তি সুবিধা হলো ভিআইপি বক্স এরিয়ায় হিটিং সিস্টেম চালু আছে। ফলে টাকাওয়ালা মানুষগুলো তীব্র শীতের মধ্যেও উষ্ণ আবহাওয়ায় খুব আরামে বসে ক্লাব ফুটবলের উত্তাপ উপভোগ করতে পারেন। স্টেডিয়ামের ভেতরটা দেখানোর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ইত্তিহাদের পানশালায়। যেখানে ম্যাচের বিরতিতে ইচ্ছেমতো গলা ভেজানোর ব্যবস্থা আছে। পানশালা পেরিয়ে গাইড আমাদের মিডিয়া জোনে নিয়ে গেল, যেখান থেকে সরাসরি সম্প্রচারের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা হয়। মিডিয়া জোন পেরিয়ে মিক্সড জোন। মিক্সড জোনে ঢুকতেই গাইড আমাকে তার পাশে দাঁড়াতে বলল। বাকি সবাইকে সাংবাদিকদের চেয়ারে বসতে বলল। এরপর গাইড আমাকে ওপরের ডেস্কে থাকা মাঝের চেয়ারের পাশেরটাতে বসতে বলল। সেই মুহূর্তে আমি আসলে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

এই স্টেডিয়ামের মাঠের ঘাস ৯৭ শতাংশ প্রাকৃতিক আর ৩ শতাংশ কৃত্রিম। ছবি: লেখক
এই স্টেডিয়ামের মাঠের ঘাস ৯৭ শতাংশ প্রাকৃতিক আর ৩ শতাংশ কৃত্রিম। ছবি: লেখক

এরপর শুরু হলো প্রযুক্তির খেলা। মিক্সড জোনের টিভি স্ক্রিন অন করতেই দেখি গার্দিওলা টিভিতে আমার পাশের চেয়ারে বসে মিটিমিটি হাসছেন! প্রথমে প্রযুক্তির গোলকধাঁধায় একটু এলোমেলো হয়ে নিজেকে সামলে নিই। এরপর দেখি, আমাদের গাইড গার্দিওলাকে প্রশ্ন করছে আর গার্দিওলা উত্তর দিচ্ছেন। প্রযুক্তির পরশে সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, একেবারে চোখের সামনে একেবারেই বাস্তব সাংবাদিক সম্মেলন চলছে। এবার এল আমার পালা। গার্দিওলাকে গাইড জিজ্ঞেস করল, What do you think about the supporters demand? তখন গার্দিওলা উত্তর দিল, It's better to know from the supporters what they want to get from me? তখন আমি বললাম, I want to see the replication of beautiful football produced by Gurdiola in Barcelona, and as a city supporter I want to win champions league in this season. আমার কথা শুনে গার্দিওলা দেখি মিটিমিটি হাসছেন। এরপর গার্দিওলা টিভি থেকে আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। সত্যি বলতে কী প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কয়েক মিনিট সময় যেন আমার কাছে থমকে গিয়েছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম গার্দিওলার সঙ্গে।

সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ায় পর আমাদের সেই ৩৬০ ডিগ্রি রুমে নিয়ে গিয়ে আবার ডিভাইস অন করে এয়ারফোন কানে দিতে বলল গাইড। এবার দেখানো হলো ম্যানসিটি ক্লাবের আগামী ২৫ বছরের পরিকল্পনা। এই মুহূর্তে ইত্তিহাদের দর্শক ধারণক্ষমতা ৫৫ হাজার। ওরা আগামী দুই বছরের মধ্যে এটি ৬৫ হাজারে নিয়ে যাবে। কারণ, ওদের পরবর্তী লক্ষ্য চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল আয়োজন করা। দর্শক ধারণক্ষমতা ৬০ হাজারের নিচে হলে উয়েফা ফাইনাল আয়োজনের জন্য ক্লাবকে বিড করতে দেয় না। এ ছাড়া সিটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কীভাবে শিশুদের পড়ালেখা এবং ফুটবল খেলায় সাহায্য করছে সেটি দেখাল। ওদের ফুটবল একাডেমি কীভাবে চলছে এবং কীভাবে এটি আরও সমৃদ্ধ করবে, তার একটি রূপরেখা আমাদের সামনে হাজির করল। এরপর গাইড আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে কাছে থাকা ডিভাইস ফেরত নিল এবং আমাদের এয়ারফোন উপহার হিসেবে দিল।

এভাবে ইত্তিহাদের ইতিহাস এবং বর্তমানের কানাগলিতে বিচরণ করে দুটো ঘণ্টা কীভাবে যে কেটে গেছে বুঝতে পারিনি। ইত্তিহাদের ক্যাম্পাস থেকে অসম্ভব সুন্দর সজীব স্মৃতি সঞ্চয় করে আবার ট্রামে চড়ে বসলাম। এবার গন্তব্য Old Trafford, ফুটবল মহানগরীর আরেক অভিজাত এলাকা। উদ্দেশ্য, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঠে বসে রেড ডেভিলদের হয়ে ইউরোপা লিগের ম্যাচে গলা ফাটানো। একজন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে এ যেন এক স্বপ্নের জগৎ থেকে আরেক স্বপ্নের জগতে ভেসে চলা!

*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা ও মাস্টার্স, ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য