সহকারী জজ নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার শেষ সময়ের প্রস্তুতি
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন সচিবালয়ের (বিজেএসসি) অধীন সহকারী জজ নিয়োগের সপ্তদশ বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের মৌখিক পরীক্ষা ২৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে চলবে আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। মৌখিক পরীক্ষার শেষ সময়ের প্রস্তুতির জন্য পরামর্শ দিয়েছেন ১৬তম বিজেএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জনকারী ও রাজশাহীর সহকারী জজ নুসরাত জেরিন জেনী।
বিজেএস মৌখিক পরীক্ষায় ১০০ নম্বর বরাদ্দ। লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি এই পরীক্ষাও সমান গুরুত্ব বহন করে। মৌখিক পরীক্ষা শুধুই মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা হয়। এ পরীক্ষাকে একই সঙ্গে বলা যায়, মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা, ভাগ্যের পরীক্ষা ও ব্যক্তি হিসেবে আপনার পরীক্ষা।
ভাইভার পোশাক
শুরুতেই খেয়াল রাখতে হবে ড্রেসআপের দিকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে ফরমাল পোশাক হিসেবে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, বেল্ট, কালো ব্লেজার ও ফরমাল শু গ্রহণযোগ্য। মেয়েদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ড্রেসকোড সাধারণত নেই। মেয়েরা শাড়ি বা থ্রি–পিস পরে সঙ্গে ব্লেজার পরতে পারেন। রঙের ক্ষেত্রে ফরমাল বেশি প্রাধান্য পায়। সাদা–কালো পরার বাধ্যবাধকতা নেই।
ভাইভা বোর্ডে করণীয়
শুরুতে রুমে ঢুকেই স্যারদের সালাম দিতে হবে। স্যাররা অনুমতি দিলে চেয়ারে বসা যাবে। বসার ক্ষেত্রে দুই হাত সামনে রেখে বসা ভালো। কথা বলার সময় চেষ্টা করবেন মার্জিত ও নমনীয়ভাবে কথা বলতে। ভাইভা শুধু মেধার পরীক্ষা নয়, এটি আপনার ব্যক্তিত্বেরও পরীক্ষা বটে। আপনি প্রথম শ্রেণির একটা চাকরিতে যাবেন, সেখানে যাওয়ার জন্য আপনি কতটা ফিট, তা–ও যাচাই করা হবে এই পরীক্ষার মাধ্যমেই। নিজেকে যতটা সম্ভব কনফিডেন্ট রাখতে হবে। সুন্দরভাবে প্রশ্ন বুঝে উত্তর করতে চেষ্টা করবেন। প্রশ্ন না বুঝলে বিনয়ের সঙ্গে আবারও জিজ্ঞাসা করবেন। স্যাররা প্রশ্ন ইংরেজি বা বাংলায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনি আপনার সুবিধামতো উত্তর করবেন স্যারের অনুমতি নিয়ে। নিজের পরিচয় ও কেন আপনি বিচারক হতে চান, এ বিষয়ে ছোট আকারে ইংরেজিতে পাঁচ থেকে ছয় লাইনের প্রস্তুতি নিয়ে যেতে পারেন।
শেষ সময়ে যেভাবে পড়তে পারেন
ভাইভা অনেকটাই ভাগ্যের পরীক্ষা। ভাইভার কোনো নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই। যেকোনো বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করা হতে পারে। এর মধ্যেই পরিস্থিতি সামলে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। যে বিষয়গুলো বিজেএস পরীক্ষার সিলেবাসে আছে, সেগুলো সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নিয়ে যেতেই হবে। মৌখিক পরীক্ষার শুরুতেই প্রার্থীর নিজের পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হতে পারে। তাই নিজের পরিচয়, পরিবার, শিক্ষাগত যোগ্যতা, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, পছন্দ-অপছন্দ, সবলতা-দুর্বলতা ও বিচার বিভাগের প্রতি আগ্রহের কারণ সম্পর্কে সংক্ষেপে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। ভাইভা বোর্ডে প্রার্থীর সুন্দর উপস্থাপনা ও মার্জিত প্রকাশভঙ্গি বেশি নম্বর পেতে সহায়ক হবে। বিজেএস ভাইভায় কিছু মৌলিক বিষয় সম্পর্কে প্রতিনিয়তই প্রশ্ন করা হয়। প্রথমেই নিজের নামের অর্থ, নামের সঙ্গে মিল আছে এমন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, নিজের জন্মদিনের ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা, বংশের পরিচয়, পরিবার, ব্যক্তিগত উপলব্ধি, ভাইভার দিনের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা বা দিবস সম্পর্কে জানতে হবে। নিজের গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল সম্পর্কে জেনে রাখতে হবে।
যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো সংবিধান। মূল সংবিধান ভালোভাবে পড়তে হবে। পাশাপাশি সংবিধানের ইতিহাস, বিভিন্ন সময়ে আসা সংশোধনী, বিভিন্ন Doctrine, উল্লেখযোগ্য কিছু মামলা সংক্ষেপে জেনে যেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংবিধানে উল্লেখযোগ্য কী কী পরিবর্তন এসেছে এবং কী কী পরিবর্তন আনা যেতে পারে, এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাওয়া হতে পারে। তাই এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকা পড়ে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারেন।
ফৌজদারি ও দেওয়ানিবিষয়ক আইনগুলোয় ভালো প্রস্তুতি রাখতে হবে। একটি মামলা বা মোকদ্দমার বিভিন্ন ধাপ ও পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে যাবেন। গুরুত্বপূর্ণ ধারা, নির্দিষ্টভাবে ধারা উল্লেখ করে উত্তর করার চেষ্টা করবেন। সাক্ষ্য আইন ও দণ্ডবিধির গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা, যেগুলো লিখিত পরীক্ষার সময় গুরুত্বসহকারে পড়েছেন, সেগুলো ভালোভাবে দেখে যাবেন।
পারিবারিক আইন থেকে উত্তরাধিকার বিষয়ে অংশ বণ্টনের বিষয়গুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন ও অধ্যাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো দেখে যাবেন। Marriage, Divorce, Dower, Maintenance, Pre-emption, Gift, Will এই অধ্যায়গুলোর বেসিক কনসেপ্ট রাখতে হবে। ধরুন, আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হলো আপনি আপনার সব সম্পত্তি আপনার বোনকে উইল করে দিতে চাচ্ছেন। আপনি কি পারবেন? এ ক্ষেত্রে কতটুকু সম্পত্তি উইল করা যাবে এবং উত্তরাধিকারী বরাবর উইল করা যাবে কি না, এ বিষয়ে আপনার জানা থাকলে আপনি উত্তর করতে পারেন ভালোভাবে।
সম্পত্তিসংক্রান্ত আইন থেকে হাইলাইটেড কিছু বিষয়, যেগুলো লিখিত পরীক্ষার সময় ভালোভাবে পড়েছেন, সেগুলোই বারবার রিভিশন দিয়ে যাবেন। ঐচ্ছিক আইনগুলোয় যেটি উত্তর করেছেন, সেটি ভালোভাবে পড়বেন আর অন্যটি প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সময় যেভাবে পড়েছেন, সেভাবে অল্প কিছু জিনিস দেখে যাবেন। প্রশ্নের যেহেতু কোনো গণ্ডি নেই, তাই যেকোনো বিষয়েই আপনাকে প্রশ্ন করা হতে পারে।
আইন বিষয়ে ভালো প্রস্তুতি রাখা আবশ্যক। কারণ, বিচারক হিসেবে আপনি আইনের প্রয়োগ করবেন ভবিষ্যতে। এর পাশাপাশি আপনাকে সাধারণ বিষয়েও প্রশ্ন করা হতে পারে। সাধারণ জ্ঞান থেকে কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। আপনার দেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিয়ে যাবেন। বাংলা সাহিত্যে গুরুত্ব দেবেন। অনেক ক্ষেত্রে সাহিত্য থেকে প্রশ্ন করে থাকেন স্যাররা। পাশাপাশি ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান থেকে মৌলিক বিষয়গুলো খুব সংক্ষেপে দেখতে পারেন। আমার ভাইভার সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাকে একজন স্যার একটি বাক্য ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বলেছিলেন, ‘মেয়েটি নাচতে নাচতে চলে গেল’। এখানে Verb এর ব্যবহার ও ব্যাকরণের নিয়ম জানতে চেয়েছিলেন স্যার।
অনেক সময় পড়াশোনার বাইরেও কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে, যেমন ভালো কোনো বই পড়েছেন কি না, বিশ্বের বিখ্যাত কিছু ব্যক্তি সম্পর্কে জানেন কি না, বিখ্যাত কিছু সিনেমা দেখেছেন কি না, দেখে থাকলে বা জেনে থাকলে কী জানেন, এই নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।
বিশেষ পরামর্শ
ভাইভা বোর্ডে পুরোটা সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। জানা বিষয়গুলোর নির্ভুলভাবে উত্তর করার চেষ্টা করবেন। সবকিছু নির্ভুলভাবে হুবহু মনে থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাই কিছু প্রশ্ন নিজের মতো করে নিজের কনসেপ্ট থেকে কাছাকাছি যতটুকু জানেন, সে হিসেবে উত্তর দেবেন। একেবারে জানাশোনার বাইরে কোনো প্রশ্ন থাকলে ভদ্রভাবে সরি বলবেন। অনেক প্রশ্নে আপনার মতামত চাওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনার মতামত এবং এর পেছনের কারণ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবেন। যতটা সম্ভব ভদ্রতা ও বিনয়ের সঙ্গে ভাইভা বোর্ডে স্যারদের প্রশ্নগুলোর উত্তর করতে চেষ্টা করবেন। শুরুতেই বলেছি, ভাইভা অনেকটা ভাগ্যেরও পরীক্ষা। আপনার ভাগ্য ভালো থাকলে, মাথা ঠান্ডা থাকলে সব সুন্দরভাবে শেষ করতে পারবেন।