চাকরির ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের বিপুল আগ্রহ বিসিএসে। গত বুধবার সকাল থেকেই প্রথম আলো কার্যালয়ে ফোন আসে অনেক প্রার্থীর। তাঁদের একটাই জিজ্ঞাসা, ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল কি আজই প্রকাশিত হচ্ছে? বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) কর্তৃপক্ষ জানাল, বিশেষ সভা শেষে ফল প্রকাশ করা হবে। এ খবর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়। এরপর দুপুরে ফল প্রকাশের পর কে কোন ক্যাডারে প্রথম হলেন, সে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা চলে।
সাধারণত প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারের কথা জানতে আগ্রহ থাকে বেশি। সেটি মাথায় রেখে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই ক্যাডারগুলোতে প্রথম হয়েছেন যথাক্রমে জান্নাতুল ফেরদৌস, কাজী ফাইজুল করীম ও মোহাইমিনুল ইসলাম। তিনজনেরই এটি প্রথম বিসিএস এবং সবাই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন। জান্নাতুল, ফাইজুল ও মোহাইমিনুলের মধ্যে আরও মিল হলো, তিনজনই তাঁদের পছন্দের ক্যাডার পেয়েছেন। দুজনই পাস করেছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর মোহাইমিনুল পাস করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে। তবে তাঁদের বিভাগ ভিন্ন। জান্নাতুল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফাইজুল ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ও মোহাইমিনুল পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা ইশরাত শারমিন প্রথম আলোকে জানান, ১১১৪৬৩৬২ রোল নম্বরধারী প্রশাসনে প্রথম, ১৬০১০২৬৩ রোল নম্বরধারী পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন এবং ১১০৮৩৬০৮ রোল নম্বরধারী পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম। ৪০তম বিসিএস পাস করেছেন, এমন কয়েকজনের কাছে রোল নম্বর ধরে খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেল জান্নাতুল, ফাইজুল ও মোহাইমিনুলকে। তথ্য ঠিক আছে কি না, তা নিশ্চিত হতে এই প্রতিবেদক তাঁদের প্রবেশপত্রের নম্বর ও পিএসসির প্রকাশিত ফলের নম্বর মিলিয়ে দেখেন।
জান্নাতুল চাকরির ভাইভায় জানলেন, প্রশাসনে প্রথম হয়েছেন
জান্নাতুল জানালেন, বিসিএসের ফল নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন। ফল প্রকাশের দিন দুপুরে সরকারি একটি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদের জন্য মৌখিক পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। স্বামী শরীফ আসিফ রহমানের মাধ্যমে জানতে পারেন, তিনি প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন। জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘বিশ্বাসই হচ্ছিল না! স্বামীকে রোল ও রেজাল্ট শিটের নম্বর এক কি না, মেলাতে বলি। নিশ্চিত হয়ে কল দিলে তবেই বিশ্বাস করি।’ জান্নাতুল বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করছেন। কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। জান্নাতুল বলেন, মা–বাবা ও স্বামী সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার ও কষ্ট করেছেন।
জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবা বি এম সবুর উদ্দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক। মা সামসুন্নাহার গৃহিণী। ঢাকার দনিয়ার এ কে হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে পাস করেন।
পুলিশ ছিল প্রথম পছন্দ ফাইজুলের
ইচ্ছা ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। আর সেখানে প্রথম বিসিএসে তাই পছন্দের দিক থেকে ১ নম্বর চয়েস দিয়েছিলেন পুলিশ ক্যাডার। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিল কাজী ফাইজুল করীমের।
ফাইজুল প্রতিদিনের মতো বুধবারও তাঁর কর্মস্থল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিলেন। স্ত্রী সুরাইয়া তামান্নাও সেখানে চাকরি করেন। স্ত্রী তাঁকে জানান, তিনি পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন। এরপর নিজে যাচাই করে নিশ্চিত হন। ফাইজুল বলেন, ‘প্রথম বিসিএসে প্রথম পছন্দের ক্যাডার ছিল পুলিশ। সেটি পেয়ে গেছি। আর কোনো বিসিএসে অংশ নেব না।’
ফাইজুলের বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। বাবা আফতাব উদ্দিন ব্যবসায়ী। মা কাজী মীর জাহান বেগম অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা।
পররাষ্ট্রে প্রথম হবেন, ভাবেননি মোহাইমিনুল
পড়াশোনা শেষে একটা বিসিএস দেওয়ার ইচ্ছা ছিল বুয়েটের মোহাইমিনুলের। ৪০তম বিসিএস টার্গেট করলেন তিনি। প্রথমে প্রিলিমিনারি ও পরে লিখিত পরীক্ষা দিলেন। ভাইভার প্রস্তুতি চলা অবস্থায় একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলেন। ভাইভা দিয়ে বুঝলেন, প্রথম পছন্দ পররাষ্ট্র ক্যাডারে হতে পারে তাঁর। তবে প্রথম হবেন, এটা ভাবেননি। ফল প্রকাশের দিন অফিসের কাজে ছিলেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলায়। ফল প্রকাশের পর দুর্বল ইন্টারনেটেও অনেকবার চেষ্টা করে ফলের পিডিএফ ডাউনলোড করে দেখলেন পররাষ্ট্রে প্রথম হয়েছেন। মোহাইমিনুল বলছিলেন, ‘যেভাবে লক্ষ্য ঠিক করেছি, সেভাবেই সব হয়েছে। নিজেকে প্রথম দেখার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এমন চাকরি করতে চেয়েছি, যার মাধ্যমে দেশের সেবা করা যায়। সেটি এখন সম্ভব হবে।’ মোহাইমিনুল শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পর ২০১২-১৩ সেশনে বুয়েটে ভর্তি হন। বাবা মোসলেম উদ্দিন আহমেদ জনতা ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আর মা আল্পনা বেগম গৃহিণী। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে হলেও বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন।
সুপারিশ পেলেন ১ হাজার ৯৬৩ জন
৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে পিএসসি। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে ২৪৫ জন, পুলিশে ৭২, পররাষ্ট্রে ২৫, কৃষিতে ২৫০, শুল্ক ও আবগারিতে ৭২, সহকারী সার্জনে ১১২ ও পশুসম্পদে ১২৭ জন রয়েছেন। গতকাল দুপুরে পিএসসির ওয়েবসাইটে এ ফল প্রকাশ করা হয়।
যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী না পাওয়ায় কারিগরি বা পেশাগত ক্যাডারের ২৫৬টি পদে সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু ক্যাডার পদে সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি, এমন ৮ হাজার ১৬৬ জন প্রার্থীকে নন-ক্যাডার পদের জন্য কৃতকার্য করা হয়েছে।
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে পিএসসি। এতে ১০ হাজার ৯৬৪ জন পাস করেন।